প্রথমে মনে হল, পদ্মপাতার গন্ধ।
তারপর মনে হল নদীর জলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা শ্যাওলার গন্ধ এবং শেষে কেন যে মনে হল নদীর জলে মাছের ঝাঁক ভেসে গেলে যে গন্ধ ওঠে, কেমন এক আঁশটে গন্ধ তিথির শরীরে।
নারী রহস্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মেয়েদের শরীরে এমনই বুঝি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এবার তিথিকে আলিঙ্গনে অবারিত মুগ্ধতায় নিয়ে যেতে চাইল অরু। তিথির হুঁশ নেই। তারও না। স্বপ্নের মতো এক অস্পষ্ট ইচ্ছার জগতে তারা ভ্রাম্যমাণ। কেন যে মনে হচ্ছিল অরুর, যে—কোনও সময় তাঁর হাত থেকে পিছলে যেতে পারে তিথি। নদীর জলে পড়ে গেলে তিথি সত্যি কোনওদিন মীন হয়ে তার অপেক্ষায় নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারে।
নদীর জলে ডুবে গেলে তাকে আর সে কিছুতেই খুঁজে পাবে না।
যখন উভয়ের হুঁশ ফিরে এল, অরণি কেমন লজ্জায় পড়ে গেল। তিথিকে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখাচ্ছিল। সে তার শাড়ি সায়া ব্লাউজ বুকে জড়িয়ে রেখেছে। এবং বারবার বলছে, তুমি যাও অরুদা, তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি বোকা আছো।
অরু কিছুটা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েছিল। সত্যি সে কিছু জানে না।
তুমি যাও না অরুদা! কে আবার দেখে ফেলবে। এবং এও বুঝতে পারছে, তিথি খুব দ্রুত সায়া গলিয়ে দিচ্ছে। তারপর শাড়ি পেচিয়ে এক দৌড়। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে তিথিদের বারান্দায় যে কুপিটা জ্বলছিল, দপ দপ করে তাও নিভে গেল।
অরণি বুঝে পেল না, স্বপ্নের জগতে তিথিকে সে মীন হয়ে জলে ভেসে যেতে কেন যে দেখল!
জলের গভীরে তিথি ডুব দিচ্ছে, ভেসে উঠছে, আবার ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ভরা গাঙে যেন একটা শুশুক মাছ। স্তন্যপায়ী মাছের ডুবে যাওয়া ভেসে ওঠা সে কতদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিথির সঙ্গে সে দেখেছে। তিথির যে কী হত, শুশুক মাছ দেখলেই জলে লাফিয়ে পড়তে চাইত। মাঝ নদীতে কিংবা কিনারে সে শুশুক মাছ ভেসে যেতে দেখলেই কেন যে বলত, অরুদা তোমার ইচ্ছে হয় না, পাখির মতো আমরা কোথাও উড়ে যাই, মাছের মতো আমরা কোথাও ভেসে যাই।
তারপরই কেন যে মনে হল, সে তিথির শরীরে আবিষ্ট হয়ে ডুবে যেতে পারেনি। আসলে জড়িয়ে ধরার উষ্ণতাই তাকে এত কাবু করে দিয়েছিল যে, সে বেশিদূর এগোতে পারেনি, কিংবা সাহস পায়নি, কিংবা স্তন অথবা শরীরের সঙ্গে তার শরীর মিশেই যায়নি, তার আগেই সে বুঝি হেরে গেছে, অথচ ভ্রাম্যমাণ কোনও শুশুক মাছের মতো জলের তলায় কেন যে মনে হয়েছিল তার, দীর্ঘক্ষণ সে বিচরণ করেছে। তার করুণ অবস্থা দেখে তিথি বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ক্ষেপেই গিয়েছিল—তুমি যাও অরুদা, তুমি যাও না। সে কাপুরুষের মতো কাজটা করে ফেলে বড় অসহায় বোধ করছে।
অথবা কোনও ঘোর থেকে সে যদি এসব দেখে ফেলে। দেখতেই পারে।
তিথিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালে তিথির শরীর তার মধ্যে নানা মোহ তৈরি করে দেয়। তিথি আজ শাড়ি পরায় সেই মোহ অতীব অনন্ত হয়ে বিরাজ করেছে তার মধ্যে। সারা দুপুর বিকেল অষ্টমীর মেলায় তিথির চঞ্চল স্বভাব তাকে যে তাড়া করেছে, সে তাও বোঝে। তিথিকে নিয়ে সে ফিরছিল, এবং এই নির্জন জায়গায় তিথিকে নিয়ে ঢুকে গেছে। ঢুকে গেছে না, ঘোরে পড়ে গিয়ে তিথির সর্বস্ব লুটে নেবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, কী যে হয়েছিল, সে কিছুই আর ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না।
সে যখন কিছুই করতে পারছিল না, কারণ সে তো জানে না, কীভাবে শরীরে শরীর বিভোর হয়ে থাকে—তার অপটুত্ব নিশ্চয়ই তিথিকে পীড়া দিচ্ছিল। তিথি তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হা হা করে বুঝি হেসেও উঠেছিল। তারপর দৌড়াতে পারে। কিংবা তিথি দাঁড়িয়ে আছে, সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে তাকে যে দেখছিল, সেটাও যে কোনও ঘোর থেকে দেখে ফেলেনি তার নিশ্চয়তা কি!
তারপরই মনে হল সে তার জামাপ্যান্টে হাত দিয়ে দেখতে পারে। রাতে স্বপ্নে কতবার প্যান্ট নোংরা করে ফেলেছে, চুপি চুপি উঠে গিয়ে প্যান্ট পালটেছে, দু—একবার বাবার কাছে সে ধরাও পড়েছে, বাবার এক কথা, বাইরে যাবি? যা। আমি জেগে আছি, ভয়ের কিছু নেই।
বাবা কি জানেন, এ—বয়সেই সবার এটা হয়। এবং সেই ভেবেই বাবা তাকে অভয় দিয়ে গেছেন। রাতে ওঠার অভ্যাস সবারই কমবেশি থাকে, বাবা কি ভেবে অভয় দিতেন তার কোনও স্পষ্ট ধারণা তার নেই। বাইরে বের হলে অন্ধকার মাঠ কিংবা বনজঙ্গলের এক ভূতুড়ে অবয়বের মধ্যে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে—সেই ভেবে যদি বাবা অভয় দেন। সে টর্চ জ্বেলে বের হয় ঠিক, এবং ধোওয়া প্যান্ট হাতে আলগা করে তুলে নেয়। তারপর বাইরে বের হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্যান্ট খুলে খুব সতর্কভাবে জংঘা এবং আশ্চর্য সব নীলাভ বনরাজিনীলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জল ঢেলে সব সাফ করে নিলে পবিত্রতা সৃষ্টি হয়। তারপর ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লে সহজেই ঘুমিয়ে যেতে পারে। আর যদি তা না হয়, সারা রাত তার অস্বস্তিতে ঘুম হয় না।
ঘোর যদি হয়।
সে তার প্যান্টের উপর প্রথমে হাত রাখল। না কিছুই ভিজে যায়নি। কিংবা পিচ্ছিল হয়ে নেই তার জংঘাদেশও। তবে তার এটা কী হল! কী দেখল! কিছুই হয়নি তার! অথচ কেন যে দেখল তিথিকে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ শুশুক মাছ হয়ে গেছে জলের নিচে। কেন যে দেখল, তিথি সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।