তিথি চুপ করে গেল। যেন বোবা হয়ে গেছে।
ঠিক আছে চল। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।
যেন কোনও গত জন্মের পাপের বোঝা বয়ে তিথি হাঁটছে। তার বোধহয় পা চলছিল না। লোকটা তার শরীর কচলাত। বাবা বুঝত কি বুঝত না সে জানে না, সেও কিছু বলত না, লোকটা বাড়ি উদয় হলেই আতঙ্কে সে পালাবার চেষ্টা করত।
তারপর তার আর কিছু মনে পড়ছে না। তার বয়সই বা কত তখন। মহেশ পাল যে ছ্যাঁচড়া স্বভাবের বাবুদের কানেও কথাটা উঠে গেল। ভুঁইঞা কাকা না থাকলে কি যে হত! লোকটাকে ডেকে বললেন, ‘মহেশ অনেক হয়েছে। তোমার অনাচারে বাবুদের ইজ্জত যেতে বসেছে। কাল থেকে যেন সকালে উঠে আর তোমার মুখ দেখি না। তিথি তোমার হাত কামড়ে দিয়েছে কেন—তুমি এত বড় অমানুষ!’
তারপর থেকেই লোকটা হাওয়া।
তিথির সবই মনে পড়ল। লোকটা যে তার আবার পেছনে লেগেছে, সেও টের পেল। ভাবতে গিয়ে চোখমুখ এত কাতর হয়ে পড়ছে যে সে আর একটা কথা বলতে পারছে না। ভয়ে বুক থেকে কান্না উঠে আসছে।
তখন সাঁজ লেগে গেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীর পাড়ে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলি—শুধু মঠের দিকটায় কিংবা নদীতে লণ্ঠন জ্বলছে—দোকানে দোকানে হ্যাজাক, ডেলাইট। এবং দূরে সেই বজরায় বোধ হয় হ্যাজাকের আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ওটা গোপীবল্লভ মহাজনের বজরা—চাউর হয়ে গেছে সারা মেলায়। কারণ যারা পুণ্যস্নান করে নদীর পাড়ে খড়কুটো জ্বেলে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে, তারাই বলাবলি করছিল—তীর্থ মাহাত্ম্যের কথা। মহাজনের মতো জাঁদরেল মানুষও বিধাতার কোপের শিকার হতে চায় না। অষ্টমী স্নানে নদীতে ডুব দিতে এসেছে।
তিথি হাঁটছিল ঠিক, তবে তার মধ্যে কোনও বিসর্জনের বাজনা বাজছে বুঝতে কষ্ট হয় না। কাছারিবাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাবারও তার ক্ষমতা নেই। অন্ধকার গাছপালার ছায়ায় তিথি কেমন নিস্তেজ গলায় ডাকল, অরুদা।
কী হল, এত পেছনে পড়ে থাকলি কেন?
তিথি নড়ছে না।
অরু কাছে গিয়ে বলল, শরীর খারাপ?
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো।
অরুর খুবই সংকোচ হচ্ছিল, রাস্তার উপর যে জড়িয়ে ধরা যায় না কিছুতেই তিথি বুঝছে না। কে কখন দেখে ফেলবে, বাড়ি ফেরার এই রাস্তাটা যতই নির্জন হোক, বাবা নাজিরখানা থেকে এখন ফিরে আসতে পারেন। বৃন্দাবনদা, হরমোহনদা, কিংবা অন্য কেউ, কত লোকই এই রাস্তায় হেঁটে যায়, সে কিছুতেই তিথি বললেও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না।
সুপারিবাগানের ভেতর ঢুকে গেলে কিছুটা আড়াল মিলতে পারে। বাগানের শেষ দিকটায় মুলিবাঁশের ঘর তিথিদের। দাওয়ায় কুপি জ্বলছে দূর থেকেও বোঝা যায়। তিথির ভাইবোনদের কোলাহলও টের পাওয়া যাবে কিছুটা ভেতরে ঢুকে গেল। বোধ হয় এভাবে পাগলের মতো ছোটা তিথির উচিত হয়নি। খুবই কাহিল হয়ে পড়তে পারে।
সে বলল, চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। তুই এভাবে না ছুটলেই পারতিস।
তিথি সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।
কেন আমি ছুটেছি, তুমি জানো?
লোকটাকে তোর এত ভয় কেন বুঝি না।
বুঝবে না। আমি মরে গেলেও বুঝবে না কিছু, কেন তিথি মরে গেল।
আবার পাগলামি শুরু করলি।
লোকটা বাবাকে টোপ দিচ্ছে। লোকটার কাছে, বাবার কাছে আমি এখন টোপ ছাড়া কিছু না। নিজেকেই ঘেন্না হচ্ছে। আচ্ছা অরুদা আমার শরীরে কী আছে বলো তো, আমি কেন টোপ হয়ে ঝুলব। শরীর জ্বালিয়ে দিলে তোমাদের সবার শিক্ষা হবে।
তিথির মধ্যে আবার আগেকার সেই তিথি হাজির। তাকে জড়িয়ে না ধরায় সে অপমানিত বোধ করছে। সমবয়সি এই মেয়েটিকে সে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। তিথিকে কেন টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হবে! কীসের টোপ। কে সেই শিকারি, যে টোপ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে ফেলে দেবে। কবে থেকেই যেন তিথি এটা অনুমান করতে পেরে তাকে নিয়ে বারবার উধাও হবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, অরুর এতে বিন্দুমাত্র সায় নেই বলে। তিথির যা সাজে, তার তা সাজে না।
অরু তো ইচ্ছে করলেই তিথিকে নিয়ে দেশান্তরী হতে পারে না। সে এখানে পড়তে এসেছে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল এমনও ভাবে। বাবুদের বাড়ির সবাই তাকে খুব ভালো এবং বিনয়ী বলে জানে। বাবার সে খুবই অনুগত। সে ইচ্ছে করলেই তিথির মতো পাগল হয়ে যেতে পারে না।
সে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।
তিথি তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তিথি কিছু চায়। কী চায় সে—যে বোঝে না তাও না। কিন্তু সে তো মনে করে এতে তিথি খাটো হয়ে যাবে। সেও খাটো হয়ে যাবে। এই সব আশঙ্কাতেই সে তিথিকে জড়িয়ে ধরতে সাহস পাচ্ছে না।
সুপারির বাগান বলে যথেষ্ট আড়াল রয়েছে। জ্যোৎস্না রাতেও কিছুটা ম্রিয়মাণ অন্ধকার এবং নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। সুপারি গাছগুলো হেলছে দুলছে। নীচে সবুজ ঘাস। তাকে জড়িয়ে তিথি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিল।
আর এ—সময়ে তিথি বড়ই বিহ্বল গলায় বলছে, অরুদা আমি আর পারছি না। কেমন নিস্তেজ গলার স্বর, এবং কিছুটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। তুমি আমার সব দেখেছ। আমার আর কিছু গোপন করার নেই। আমার সব ভেসে যাচ্ছে অরুদা।
আবার সেই স্খলিত গলার স্বর—আমি ডুবে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে না ধরলে বাঁচব না।
আর অরু কেমন এক আশ্চর্য গন্ধ পেল তিথির শরীরে। ভেসে গেলে কিংবা ডুবে গেলে মেয়েদের শরীরে এসময় এক আশ্চর্য গন্ধে ভরে যায় বোধ হয়।