এই তিথি! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? গোবর্ধন দাসের দোকানে যাবি না!
যে সম্বিত ফিরে পেল সে। তার তো আর কিছুই দরকার নেই। সে তো সবই পেয়ে গেছে। চুড়ি পরে আর কী হবে! তবু অরুদার কথা সে ফেলতে পারল না। গোবর্ধন দাসের দোকান আস্তাবলের কাছে। সে সেখানে ছুটে যেতে চাইলেই সহসা কে যেন বলল, এই তুই তিথি না!
সে থমকে দাঁড়াল। লোকটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে! আবার মনে হল লোকটাকে সে যেন চেনে। গলায় কণ্ঠি, মাথায় ছাঁটা চুল, ধুতি পরনে, ফতুয়া গায়। কপালে তিলক কাটা—লোকটা রাস্তা আগলে আছে। সামনে তাকে কিছুতেই এগোতে দিচ্ছে না।
কী রে জবাব নেই কেন। তুই তিথি না! গোরাচাঁদের আগের পক্ষের মেয়ে না তুই!
তিথি বলল, হ্যাঁ, কেন!
তোকে কত ছোট দেখেছি। তুই কবে এতবড় হয়ে গেছি—তোর বাপের দোকানে গেলাম। বলল, দেখুনগে হয় বাড়িতে আছে, নয় মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললাম, তোর তো এঁটো খাওয়ার অভ্যাস! অভ্যাসটা আছে, না গেছে।
অরুর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। একজন আগন্তুক যদি গায়ে পড়ে তিথিকে অপমান করতে চায়, সে ছাড়বে কেন।
অরণি বলল, কে বলেছে ও এঁটো খায়! আপনি কে!
আরে আমি জানি না ভাবছ। বাবুদের আমি তোলা আদায় করতাম। তোমার বাবা আমাকে চেনে। তিথির বাবাকে পালমশাই খবর পাঠিয়েছেন। ঐ যে দেখছ, দূরে, ঠিক বরাবর দেখ, দেখছ না, নদীর বুকে বজরা নৌকা একখানা, ওখানে কর্তামশাই তার পরিবার নিয়ে আছেন। মহাঅষ্টমী স্নান বলে কথা। আমাকেই পাঠাল, আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছি, পাই কোথা। এখানে এসে গোরাচাঁদের কথা মনে পড়ে গেল। আয় মা, তুই যে অন্নপূর্ণা, কে না জানে! চল আমার কর্তামশাইকে দর্শন দিয়ে আসবি।
লোকটা কি পাগল! অরণির এমনই মনে হল। কিন্তু লোকটা যে বলল, সে তার বাবাকে চেনে! তিথির বাবাকেও চেনে। লোকটাকে চটাতেও পারে না! সে কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে জানতে পারলে বাবা খুবই দুঃখ পান।
কী করে আর অরু! শুধু বলল, রাস্তা ছাড়ুন আমরা যাব।
কোথায় যাবে? তুমিও সঙ্গে চল না। কর্তামশাই তোমাকে দেখলে খুশিই হবেন। তোমার বাবা বন্দরে গেলে, মহাজনের সঙ্গে একবার দেখা না করে আসেন না। বাবুরাও চেনে। কত বড় মানুষ, বড় মনকষ্টে ভুগছেন।
অরণি ফিক করে হেসে দিল। লোকটার কাতর অনুনয় তাকে ভারী কৌতূহলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কে মহাজন, সে নামই শোনেনি। অথচ লোকটা যেভাবে কথা বলছে, তাতে কর্তামশাইটি যে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না। বজরায় চেপে পুণ্যস্নানে এসেছেন। তার দাসী বাঁদি চাকর—বাকরের মধ্যে বোধ হয় এই লোকটিও পড়ে। বজরার পাশে আলাদা নৌকায় তারা আছে। অরু খুব গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে পরে যাবে। ওর বাবাকে না বলে যায় কী করে?
তখনই তিথি কেমন লোকটার শরীরে দুর্গন্ধ পেল। লোকটার হাবভাব একদম ভালো না। মেলায় দুষ্টু লোকের অভাব থাকে না। সে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, শিগগির চলে এসো অরুদা। বলেই ছুটতে থাকল। দ্রুত এবং যত সত্বর সম্ভব লোকটার নাগাল থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য যেন ছুটছে।
অরণিও ছুটতে থাকল। তিথি কি ভয় পেয়ে গেছে! ঝাউতলার কাছে গিয়ে দেখল তিথি দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাঁপাচ্ছে। চোখ মুখে ভীষণ উত্তেজনা। এত হাঁপাচ্ছে যে কথা বলতে পারছিল না। প্রচণ্ড ঘামাচ্ছে।
অরণিও দম নিতে পারছিল না। মন্দিরতলা থেকে এই ঝাউতলার দূরত্ব কম না। তিথি কখনও নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে—এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায়। সোজা রাস্তায় ভিড়ের জন্য হাঁটা যাচ্ছে না। তিথি পালাবার জন্য নৌকাগুলির উপর দিয়ে ছুটছিল। কোনও নৌকা কাত হয়ে যাচ্ছে, কোনও নৌকা টলে উঠছে, নৌকার আরোহীরাও তাকে তেড়ে গেছে—কি দস্যি মেয়েরে বাবা! কার মেয়ে? মেলায় এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।
কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই তিথি আর এক নৌকায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, চরের কাছে রাস্তায় এত ভিড় নেই। সে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে যখন উঠছিল, সব নৌকা থেকেই মানুষজন চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।
কার মেয়ে?
কোথায় থাকে?
পরীর মতো জলে উড়ে বেড়ায়। মা—বাবাই বা কেমন।
কেউ বলল, কচি খুকিটিও নও। লজ্জাশরম খেয়ে বসে আছো। পায়ের শাড়ি তুলে নৌকা থেকে নৌকায় লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছ!
তিথি কিছুই গ্রাহ্য করছিল না। সে ঘাটের সিঁড়ি ধরে আবার জনারণ্যে মিশে গেছে। লোকটা তাকে খুঁজে পেলেই যেন তার মরণ।
অরুকেও সবাই দেখেছে, মেয়েটার পিছু পিছু নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়ছে।
এই তিথি, কী হল তোর?
শিগগির চলে এসো।
কেন!
বলছি, চলে এসো! কেন, পরে বলব।
এখন তারা দুজনেই মজা খালের সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর বিশাল বিলাতি গাবের গাছ। তার ঘন ছায়ায় ঠান্ডা হয়ে আছে জায়গাটা। মানুষজনের চলাচল কম।
দুজনই এতক্ষণ হাঁপাচ্ছিল। দুজনেই এবারে যেন কিছুটা ধাতস্থ। তিথি বলল, লোকটা ভালো না অরুদা। মহেশ পাল বাজারে তোলা আদায় করত। এতক্ষণ সব মনে পড়ছে। লোকটা ছ্যাঁচড়া স্বভাবের। বাবুরা তাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার কেন এখানে উদয় কিছুই বুঝছি না।
অরু বলল, তোর বাবাকে সত্যি চেনে?
চিনবে না কেন? বাবাকে বাজারে কিছুতেই বসতে দেবে না। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসত। বাবার তো জানো তখন মাথা খারাপ। ঠাঁই নেই কোথাও। বাজারের ফাঁকা জায়গায় ফুলুরি ভেজে পয়সা হত, লোকটার হম্বিতম্বিতে বাবা খুবই ঘাবড়ে গেল। পরে দেখেছি, আমাদের বাড়িতেও আসত। বাবা না থাকলে…