বাড়িটায় ঢুকলেই মনে হত চারপাশে যেন সাজানো গোছানো সবকিছু। শান বাঁধানো মেঝে চক চক করছে। খালি পায়ে হাঁটলে ঠান্ডায় পা কেমন শির শির করত। বারদী গ্রামটায় ঢুকে বুঝল, শুধু পর পর পাকাবাড়ি, তারপর দু—মাথা সমান উঁচু পাঁচিল কতদূর চলে গেছে! পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্যাঁতলা ধরা দেয়াল, টিন—কাঠের বাড়িঘরও চোখে পড়ল। রাস্তাটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে বলে সে সবই দেখতে পাচ্ছে। তার বাবাকে এই এলাকার মানুষজনও যে চেনে, এতে তার কিছুটা অহঙ্কার হচ্ছিল। বাবার সঙ্গে এত লোকের পরিচয় আছে সে জানতই না। বাবাকে সে এমনিতেই সমীহ করে, বাবার সঙ্গে বের হয়ে দূরদেশে যাবার সময় মনে হল বাবা তার একজন মুসাফির। তিনি এই সব গ্রাম মাঠ ভ্রমণ শেষে নদীর শেষ প্রান্তে গিয়ে শেষে তাঁর কর্মস্থলে উঠেছেন।
জগদীশ বলল, শোনা যায় চৈতন্যনাগের পিতাঠাকুর বিখ্যাত ডাকাত সর্দার ছিলেন। মেঘনা নদীতে তার লোকজন, নৌবহর, ছিপনৌকা, সবই মজুত থাকত। পঞ্চাশটা বৈঠায় নৌকা নদীর উপরে উড়ে যেত। এখন আর সেই ছিপ নৌকাও নেই, ডাকাতিও কেউ করে না। চৈতন্যনাগের বংশধরদেরও পাত্তা নেই। তারা শহরে বাড়িঘর বানিয়ে থাকে। এমন অজ পাড়াগাঁতে কার পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয় বল!
শহরে সব পাকাবাড়ি না বাবা?
সব কেন হবে। সব কি কখনও পাকাবাড়ি হয়? সবার হাতে এত পয়সা কোথায়। গরিব মানুষজনেরও তো অভাব নেই শহরে।
অরণি জানে বাবাকে বাবুদের মামলা মোকদ্দমার তদারকি করতে প্রায়ই শহরে যেতে হয়। বাবা শহরে রাত্রিবাসও করেন। সেই বাবার সঙ্গে সে হেঁটে যাচ্ছে। সোজা কথা!
শহরের পাকা রাস্তায় আপনি কখনও হেঁটে গেছেন।
হ্যাঁ গেছি, কেন?
আমি একবার আপনার সঙ্গে যাব।
যাবে। বড় হও।
আচ্ছা বাবা মদনগঞ্জে পাকা রাস্তা আছে?
আছে। হরিহরবাবুর প্রাসাদের সামনের কিছুটা রাস্তা পাকা। ঠিক পাকা বলা যায় না, আসলে নদী পাড় না ভাঙে, সেজন্য নদীর ধারের কিছুটা এলাকা বাঁধিয়ে দিয়েছেন বাবুরা। গেলে সবই দেখতে পাবে।
মদনগঞ্জে কি সব পাকাবাড়ি।
গেলেই দেখতে পাবে।
বাবুদের বাড়ির প্রাসাদে পরী ওড়ে নাকি?
জগদীশ হেসে ফেলেছিলেন।
ওড়ে। যে যেমন দেখে অরু।
তারপরই মোক্ষম কথাটা বলে ফেলল অরু।
আমি আবার কবে ফিরব? মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।
জগদীশ বললেন, ঐ দেখ নদী। স্টিমারঘাটে লোকজন জড়ো হচ্ছে। মানুষতো এক জায়গায় থাকে না, তাকে স্থানান্তরে যেতেই হয়। তাড়াতাড়ি ভর্তি করে না দিতে পারলে একটা বছর নষ্ট হবে। মাসখানেক বাদেই এনুয়েল পরীক্ষা। ক্ষিতিমোহনবাবু তো বললেন, ভর্তি করে দিন ভুঁইঞামশায়। ছেলের একটা বছর নষ্ট করবেন কেন। পড়াশোনায় ভালো যখন ঠিক পাশ করে যাবে।
পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি কিন্তু চলে আসব।
জগদীশ অগত্যা বললেন, ঠিক আছে পরীক্ষা দাও। কাউকে না হয় তোমার সঙ্গে পাঠাব। আমার তো সময় হবে না, দেখি কাকে পাঠাতে পারি।
অরু তখনই দেখতে পেল সেই নদী—মেঘনা। পারাপারহীন হয়ে আছে নদী—ও—পাড় দেখা যায় না। অনন্ত জলরাশি ছাড়া সামনে যেন কিছু নেই। এদিকটায় নদীর চড়া পড়ায় স্টিমারঘাট দূরে সরে গেছে। বাবা লোকনাথের অভ্রান্ত নির্দেশে নদী আর এদিকটায় এগোতে সাহস পায়নি। চড়ার জমিতে চাষ—আবাদও হচ্ছে।
তারা আল ধরে দ্রুত হাঁটছিল।
জমিতে লতার মতো গাছ বাড়ছে।
জগদীশ বললেন, এগুলো সব পটলের জমি। এগুলো সব পটলের লতা।
জগদীশ যেতে যেতে পুত্রকে রাস্তায় দু—পাশের মাঠঘাট চেনাচ্ছিলেন। কিছু যাযাবর পাখিও উড়ে এসেছে—চড়ার যেদিকটায় এখনও জোয়ারের সময় জলে ডুবে যায়, সেখানে চাষ—আবাদ নেই। কিন্তু হাজার হাজার পাখির ওড়াউড়ি আছে।
যাযাবর পাখিরা যে হিমালয় পার হয়ে উষ্ণতার জন্য এ—দেশে চলে আসে, এবং শীতের শেষে আবার সাইবেরিয়ায় উড়ে যায় যেতে যেতে জগদীশ পুত্রকে তাও জানালেন।
অরু তার গ্রাম মাঠ চেনে। তাদের গ্রামে কোনও পাকাবাড়ি নেই। তাদের গাঁয়ে কেন, কাছাকাছি কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি নেই। সেতো ছোট কাকার সঙ্গে বাজার হাট করতে দু—এক ক্রোশ কখনও হেঁটে গেছে, বর্ষাকালে নৌকায় বাজার হাট করতে যাওয়ারও মজা কম না।
কিন্তু সে কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি দেখেনি। কেবল দনদির বাজার পার হয়ে লাধুর চরের দিকে যাবার রাস্তায় একটি ছোট্ট মিনা করা শান বাঁধানো মসজিদ দেখেছে। কাচ হতে পারে, অথবা অন্য কিছুও হতে পারে। রোদ উঠলে মসজিদের মিনার এমন সোনালি রঙ ধরে যে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। গাঁয়ের সব বাড়িঘরই হয় টিন কাঠের, না হয় মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। মাটির ভিটে। গরিব মানুষেরা খড়ের ঘরে থাকে—ছোট ছোট কুটিরের মতো লাগে দেখতে।
এই গাছপালার মধ্যে, নদীনালার পাড়ে পাড়ে অবিশ্রান্ত এই নিবাস তৈরি করে বসবাসের মধ্যে মানুষের আশ্চর্য এক মোহ তৈরি হয়ে যায়। অরু হাঁটে।
যেদিকে চোখ যায়, এখন শুধু ধু ধু বালি রাশি। সে চড়া পার হয়ে যায় বাবার সঙ্গে। অদূরেই সেই বিশাল অশ্বত্থ গাছ, তার নিচে স্টিমারঘাটের স্টেশনবাবুর আটচালা বাড়ি। চা সিগারেট বিড়ির দোকান, একদিকে একটা কুঁড়েঘরে একজন সাধুবাবা ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। স্টিমারযাত্রীদের ভিড়। সবই অতি দেহাতি মানুষ। মাথায় বোচকা। কাঁধে ঝোলানো কাস্তে এবং মাথলা। পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া গায়। তারা উজানে ধান কাটতে বর্ষায় বের হয়ে গেছে, হেমন্তের শেষাশেষি দেশে ফিরছে। কিছু বাবুমতো মানুষ, তাদের পরিবার যাত্রীনিবাসের, বাঁশের মাচানে বসে আছে। কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতে হবে। চিরপরিচিত পৃথিবী তার, এখানটায় এসে যেন একেবারেই হারিয়ে গেছে।