তিথিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে অরণির আর কোনও সংকোচ থাকল না।
নদীর পাড়ে গিজ গিজ করছে লোক। চাদর টাঙিয়ে অস্থায়ী তাঁবু তৈরি হয়েছে। স্টিমারঘাটের বিশ্রামাগারে মানুষজন গিজ গিজ করছে। রাস্তার দু—দিকেই জিলিপির দোকান, বিন্নি খই বস্তা খুলে বিক্রি হচ্ছে। লাল বাতাসা, আর কোথাও রসগোল্লা, বুঁদে, যে যা পারছে নদীতে ডুব দিয়ে এসে শালপাতায় খাচ্ছে।
তিথির কোনও দিকেই যেন খেয়াল নেই।
সে হেঁটে যাচ্ছে। ভিড় দেখলেই সরে দাঁড়াচ্ছে। হেমন্তবাবুর প্রাসাদ পার হয়ে, সেই বড় মাঠ, মাঠেও তাঁবু পড়েছে। কোথাও আয়না, চিরুনি, তাবিজের মালা, মণিহারি দোকানে সুগন্ধ তেল, সাবান, কী নেই! যেন সারা দেশ থেকে যে যা পেরেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
তিথির কোনও দিকেই খেয়াল নেই।
ক্রোশখানেক পথ হাঁটতে হবে। এদিকটায় বেশ ফাঁকা। তারপর বাজার। তার বাবা গোরাচাঁদ মেলায় জিলিপির দোকান দিয়েছে, সে ওদিকটায় কিছুতেই গেল না। যেন সে তার বাবাকে এড়িয়ে কোনওরকমে এখন মন্দিরে পৌঁছতে চায়। হাতে কাঁসার ঘটি, তাতে নদীর জল—মন্দির সংলগ্ন মাঠে মিসরি, বাতাসার দোকান—অরু বলল, মিসরি বাতাসা কিনতে হবে তো!
তিথির গায়ে ভারী সুঘ্রাণ। শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বলল, কী সুন্দর না, কত কারুকাজ করা রেশমি সুতোয়। বাতাসা মিসরির ঠোঙা শাড়ির আঁচল মেলে তুলে নিল। এক হাতে কাঁসার ঘটি আর আঁচলে বাতাসা মিসরির ঠোঙা। সে ভিড় ঠেলে অরণির হাত ধরে মন্দিরে ঢুকে গেল। তারপর সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। অরণি কিছুই বলতে পারছে না। জায়গাটা মানুষজনের যাওয়া—আসায় জল—কাদায় মাখামাখি।
তিথি সবই করছে, যেমন ফুল বেলপাতা তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, শিবের মাথায় জল ঢালতে বলছে। এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকছে, ভোগের মিসরি বাতাসা কলাপাতায় রেখে দিচ্ছে। তিথি প্রণাম করে উঠে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অরণি আর কী করে, সেও হাঁটু গেড়ে প্রণাম করছে।
ফেরার সময়ই অরণি না বলে পারল না, কিরে, তোর সেই দোকান দেখছি না! দু—হাত ভরে কাচের চুড়ি পরবি বললি, তুই কেমন হয়ে যাচ্ছিস। গোবর্ধন দাসের দোকান কোথায়?
তিথি হাসল। তুমি আমাকে কিনে দেবে?
কোথায় দোকান।
তিথি বলল, থাক।
না থাকবে না। কোথায় দোকান বল!
অরণি মেলায় সেই দোকান কোথায় খুঁজে বেড়াতে থাকল। তিথির লজ্জা হয়েছে। তিথির এই আচরণে সে কিছুটা বেকুফ। চারপাশে এত জিলিপির দোকান মিষ্টির দোকান, সে কিছুই যেন দেখছে না।
অরণি এবার নিজেই বলল, আয়। জিলিপি খাই। গরম গরম জিলিপি আমার খেতে বেশ লাগে।
তুমি খাও, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
তোকে কেউ কিছু বলেছে?
কী বলবে!
আমার সঙ্গে আসায়?
না। কেউ কিছু বলেনি। বললেই শুনব কেন! তুলিদি ডেকে পাঠিয়েছিল, মেলায় আমার সঙ্গে যাবে। আমি তো সব বুঝি অরুদা। তোমার সঙ্গে মেলায় ঘুরি তুলিদির পছন্দ না। আমিও বলে দিয়েছি, না, যেতে পারব না। ছোট তরফের বউদিমণি ডেকে পাঠিয়েছে।
তারপরই মেলায় মন্দিরের সামনে টেনে নিয়ে গেল তাকে।
একটা কথা বলব!
বল।
তুমি মন্দিরে দাঁড়িয়ে বলবে, তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দেখনি!
অরু বলল, কেন তুলি তোকে কিছু বলেছে?
তুলিদি যে বলল, তুমি তাকে প্রায়ই স্বপ্নে দ্যাখো।
মিছে কথা।
মন্দিরে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বলো, মিথ্যে কথা।
সে ভেতরে ঢুকে দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মিথ্যে কথা। তুলিকে আমি কখনোই স্বপ্নে দেখিনি।
তিথি কী খুশি!
সে তার নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। অরুর হাত ধরে হাঁটছে। এতক্ষণ চারপাশে কী ছিল, কারা ছিল সে কিছুই খেয়াল করেনি। কাচের চুড়ির কথাও মনে ছিল না। অরুদা, তুলিদিকে স্বপ্নে দেখে এই তাড়নাতেই সে কাহিল ছিল। দেবতার সামনে কেউ মিছে কথা বলে না। অরুদা দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, তুলিদিকে কখনোই স্বপ্নে দেখেনি। স্বপ্নে না দেখলে ভালোবাসাও হয় না। সে কিছুতেই এতক্ষণ নিজের কথাটা বলতে পারছিল না—তাকে অরুদা স্বপ্নে দ্যাখে কি না।
অরণি বানিয়ে বলল, জানিস সেদিন রাতে তোকে স্বপ্নে দেখলাম। তুমি আমি মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। গরম জিলিপি ভাজা খাচ্ছি। তারপর নদীর চরে নেমে গেলি, জলে মাটির প্রদীপ ভাসালি।
আর তিথিকে পায় কে? মন্দিরে না নিয়ে এলে সে কিছুই জানতে পারত না। তার যে কত কাজ এখন। পুণ্যার্থীরা নদীর পাড়ে জড়ো হয়ে ডুব দিয়েছে। যে যার মতো ব্রত উদযাপন করছে। কেউ অঘোর চতুর্দশী ব্রতের জন্য ধুতুরা ফুলের মালা গলায় পরে পুরোহিতের সামনে বসে গেছে। কেউ মৌনি স্নান করছে—ভূত চতুর্দশী ব্রত, সাবিত্রী চতুর্দশী—যার যেমন মানত। নদীর বুকে যতদূর চোখ যায় শুধু নৌকা আর নৌকা, কোনওটায় ছই দেওয়া, গয়না নৌকাও আছে। পানসি বজরা—যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষের সমারোহ। জলে প্রদীপ ভাসাচ্ছে কেউ। তিথি তার অরুদার কল্যাণ কামনায় জলে প্রদীপ ভাসিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকল। স্রোতের মুখে প্রদীপ ঘুরে ঘুরে কতদূর নিমেষে চলে যাচ্ছে।
মন্দিরতলায় সাধু সন্নেসিদের ভিড়। মাঠের দিকটায় নাগরদোলা, হাড়ি পাতিলের দোকান, জাদুকরের তাঁবু, কোথাও আবার হরিসংকীর্তন, খোল করতালের সঙ্গে জায়গাটায় যেন মাটি ফুঁড়ে ধ্বনি উঠছে। অরু হাত ধরে তিথির কেন জানি মনে হচ্ছিল আশ্চর্য এক করুণাধারায় সে ভেসে যাচ্ছে। সে মোহিত হয়ে গেছে সব দেখে। কিছুতেই তার নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।