ডাল না কাটলে দা নিয়ে পেয়ারাতলায় কেন?
তোদের গাছ?
হা আমাদের গাছ।
বৃন্দাবনদা চেঁচাচ্ছে, অরুদাদা ও গাছের ডাল কাটবে না। কানে উঠলে বড়কর্তা রাগ হজম করতে পারবেন না।
অবশ্য গাছটা যে খুব দামি সে জানত। কাশীর পেয়ারা—এক একটা পেয়ারা পোয়াটেক ওজনের। বড়কর্তা গাছটা কাশী থেকে আনিয়েছিলেন কি না সে জানে না, তবে গাছটার প্রতি বড়কর্তার তীক্ষ্ন নজর থাকে সে জানে। সে গোপনে ডাল কাটবে ভেবে গাছের নিচে ঘুর ঘুর করছিল। মেয়েটার স্বভাব এত মন্দ, ঠিক খেয়াল রেখেছে। নিজের হলেও কথা ছিল।
সে বলেছিল, অমলদা বলেছে কাটতে।
কে অমলদা?
যেন তিথি বাড়ির ছোটবাবুকে চেনেই না।
ডাকব, অমলদাকে। তুই বাড়ির ছোটবাবুকে চিনিস না। তাদের এঁটো খেয়ে তুই মানুষ।
আমি কাউকে চিনি না। সোজা কথা বলে দিলাম, ডাল কাটবে না। কাটলে বিপত্তি হবে।
অমলদাও ছুটে এসেছিল।
কি হয়েছে রে অরু?
ডাল কাটতে দেবে না।
সহসা তেড়ে গেল তিথিকে, তুই কে রে? যা ভাগ।
তিথি কি সে মেয়ে! সে ছুটে এসে তার হাত থেকে প্রায় জোরাজুরি করেই দাটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করল। এবং এতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। সে কিছুতেই ডাল কাটতে দেবে না। সে হাতের দা ছাড়বে না। সহসা তিথি তাকে জাপটে ধরে দা কেড়ে দৌড়। সে কিংবা অমল কেউ তার নাগালই পেল না।
পরে দেখা হলে বলেছিল, এমন সুন্দর গাছটায় ডাল কেউ কাটে! মায়া হয় না!
কত কথাই যে মনে হচ্ছিল অরণির।
অরু তারপর ক্রমশ আরোগ্যলাভ করতে থাকলে একদিন তিথিই তাকে ধরে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। স্কুলেও সে ক্রমে যেতে পারছে। এবং এভাবে নদীর ঘাটে এক সময় অষ্টমী স্নানের পরবও শুরু হয়ে গেল।
বর্ষায় নদীর দু—পাড় এমনিতেই দেখা যায় না। কত সব একমাল্লা, দোমাল্লা নৌকায় পুণ্যার্থীরা চলে আসছে। পানসি নাও দেখা গেল। নদীর উত্তরের চরের দিকটায় ললিত সাধুর আশ্রম, সেখানেও হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ভিড়। সড়ক ধরে ক্রোশখানেক হেঁটে গেলে সেই মঠ মন্দির—সেখানেও পুণ্যার্থীরা জড়ো হয়েছে। সারা নদী জুড়ে বজরা, পানসি। আনারস, তালের নৌকারও বিশাল বিশাল বহর। নদীর পাড়ে বাবুদের সব প্রাসাদের পর প্রাসাদ, সেই সব প্রাসাদেও দূর দেশ থেকে এসেছে আত্মীয়স্বজনরা। নদীতে ডুব দিয়ে কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা বলবে বলে এসেছে।
তিথিও বসে নেই। সকাল থেকে সে ছোটপিসির সঙ্গে ফুল দুর্বা তুলেছে। তিল তুলসী কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রেখেছে, সঙ্গে হরীতকী। বাবুদের মেয়ে বউরা ঘাটে ডুব দিতে যাবে। হরমোহনদাদুও বসে নেই। মাথায় ফেট্টি বেঁধে কাঁধে বাঁশের লাঠি ফেলে সবার আগে আগে যাচ্ছে।
তিথি অরণির দরজায় এসে ডাকল, কী হল? বসে থাকলে কেন! ঘাটে ডুব দিতে যাবে না। সবাই যাচ্ছে। এ—দিনে নদীর জলে ডুব দিলে কাশীবাসের পুণ্য হয় জানো!
অরণি চারপাশে খাতা বই মেলে বসে আছে। ওর এসবে খুব একটা বিশ্বাস নেই। তাছাড়া একগাদা টাস্ক বাকি। দ্বিজপদ সার টাস্ক দিয়ে গেছেন রাতে। সে বই—এর ভেতর ডুবে থেকেই বলল, তোরা যা, আমি পরে ডুব দিয়ে আসব।
পরে ডুব দিলে হবে! সময় পার হয়ে যাবে না। তুমি কিছুই জানো না। পড়া তো তোমার সারাজীবনই থাকবে—কিন্তু এই পুণ্যস্নান, এত গ্রহ সমাবেশ আবার কবে হবে কেউ জানে! সব বছর অষ্টমী স্নান হয়। মহাঅষ্টমী স্নান কালে ভদ্রে হয়।
আসলে তিথি ভেতর বাড়িতে যা শোনে তাই এসে উগলে দেয়।
অগত্যা, তাকে যেতেই হল। ডুবও দিতে হল। কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গাও বলতে হল।
তিথি আজ শাড়ি পরেছে। তিথিকে এত লম্বা লাগছিল দেখতে যে সে অবাক না হয়ে পারেনি। ফেরার পথে এক ফাঁকে সে তার কাছে এসে অতি সতর্কভাবে বলছিল, মন্দিরে যাব। আমাকে তুলিদি সঙ্গে নেবে বলেছে। তুলিদির সঙ্গে যাব না। বলেছি, ছোট তরফের বউদিমণির সঙ্গে যাব। বউদিমণি খবর পাঠিয়েছে। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।
তারপরই আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, মনে আছে?
কী মনে আছে, কী জানতে চাইছে, অরণি বুঝতে পারছে না।
তিথি মনে করিয়ে দিল, তোমার অসুখের সময় মন্দিরে মানত করেছি। বাতাসা মিসরি কিনতে হবে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কালভৈরবীর মন্দিরে যাব।
তিথি ঠিক দুপুরেই চুপি চুপি তার ঘরে হাজির। তাড়াতাড়ি রওনা না হলে মন্দির দর্শন করে বাড়ি ফেরা যাবে না। তিথির জন্য বাতাসা মিসরি কিনতে হবে, অরু সেজন্য বাবার কাছ থেকে টাকা নেবার সময় বলল, তিথি যে কি না, আমার জন্য মন্দিরে মানত করেছে। ও পয়সা পাবে কোথায়। থলে থেকে তোমার টাকা নিয়েছি।
জগদীশ আজ নাজিরখানায় যাননি। সকাল থেকেই তাঁর কাজের শেষ ছিল না। বাবুরা সবাই ঘাটে ডুব দিতে যাবেন। নতুন কাপড় গামছা সে ঘরে ঘরে হরমোহনকে দিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। বউঠানের জন্য লালপেড়ে, নলিনীর জন্য সাদা থান, তুলির জন্য লম্বা নতুন ফ্রক, বউমাদের জন্য তাঁদের শাড়ি—ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে সবাই আজ নতুন জামা—কাপড় পরবে। ধর্মাচরণের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে সেই নিয়েও তাঁর ভাবনা কম ছিল না। অরণিকে নিয়ে তিথি মন্দিরে যাবে, মানত থাকলে না গিয়েও উপায় নেই, অরণি টাকা নেবার সময় এজন্য তিনি না বলে পারলেন না—বেশি করে নাও। মেলায় গেলে কেনাকাটা করতে হয়। তিথি কিছু নিতে চাইলে কিনে দিয়ো। ওর তো দেখার কেউ নেই।