যখনকার যে ফল, কোঁচড়ে নিয়ে ঘোরার স্বভাব। কামরাঙ্গা, লটকন, আঁশ—ফল—কোথায় যেসব পায়! জমিদারবাবুদের বাড়িগুলি পার হয়ে গেলেই মজা খাল, মজা খালের পাড়ে পাড়ে অজস্র গাছপালা, ঝোপজঙ্গল। তিথি জানে কোথায় কোন গাছ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোন গাছে কী ফল পেকেছে—জমিদারিতে এলাহি গাছপালা। জঙ্গলেরও যেন ব্যবস্থা আছে। দিঘির পাড়ে বিলাতি গাব গাছের ছায়া বিকালে লম্বা হতে হতে দিঘিটাকে অন্ধকার করে দেয়। কালো জল, থামের মতো বড় বড় সব গজার মাছ ভেসে উঠলে তিথিই তাকে নিয়ে গেছে সেখানে—তিথিই খবর দিত, গাছে বিলাতি গাব পেকেছে। যেমনি গাছ, তেমনি তার বিশাল কাণ্ড। আর গাছে বড় বড় তেল চুকচুকে পাতা। গভীর ঘন ছায়ার মধ্যে লাল রঙের পাকা বিলাতি গাব তিথির চোখ এড়ানো কঠিন। জমিদারবাবুদের দেশটা সে যেন চিনেছে তিথির চোখ দিয়ে।
তিথি একটা বালিশ দিয়ে গেছে মাথার কাছে। ইজিচেয়ারে মাথায় বালিশ দিয়ে সে তিথির কথাই ভাবছিল।
মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়?
এভাবে জীবন নিয়ে খেলা তিথির পক্ষেই সম্ভব। কারণ তিথি অনাথ। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাটা খেয়ে সে বড় হয়ে উঠছে।
অরণি ভাবল অষ্টমী স্নানে এবারে তিথিকে নিয়ে যেতেই হবে। কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। মেয়েটাও বেশি কিছু চায় না। ভালোবাসলে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়—ভালোবাসার দাম সামান্য কটা কাচের চুড়ি—ভাবলেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায় তার।
একমাত্র পূজার ছুটিতে অরণি বাড়ি যেতে পারে। স্টিমারে পাঁচ সাত ঘণ্টা লেগে যায় বারদি যেতে। সেখান থেকে গয়না নৌকায় সে বাড়ি যায়। বাবা সঙ্গে থাকেন। গেল পূজায় সে একাই গেছে। গাঁয়ের লোকজন বারদির ঘাটে কেউ না কেউ থাকে। ছোটকাকাও চলে আসেন তাকে নিতে।
বাড়ি গেলেই এক কথা কাকিমার, ও সেজদি দ্যাখ এসে, অরু আমাদের কত বড় হয়ে গেছে! সেদিনকার ছেলে, দেখলে চেনাই যায় না। এক একটা বছর যায় আর সে লম্বা পা ফেলে যেন দৌড়ায়। তিথিরও হয়েছে তাই।
পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় তিথিই তার সব গোছগাছ করে দেয়। জামা—প্যান্ট কেচে সব ধোপা বাড়ি দিয়ে আসে। তার বইপত্র গুছিয়ে দেয়। এবং স্টিমারঘাটেও যাওয়া চাই তার। হাতে টিনের স্যুটকেসটি তিথি কিছুতেই কাউকে দেয় না। স্টিমারে উঠে আসে বাবার সঙ্গে। তারপর স্টিমার ঘাট থেকে ছেড়ে দিলে মঠের চাতালে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ স্টিমার দেখা যায়—দাঁড়িয়ে থাকে।
অকারণে ঝগড়ারও শেষ নেই।
ব্যাটবল খেলার জন্য স্টাম্প বানাচ্ছে সে। মেজদা শহর থেকে ব্যাট কিনে এনেছে। একটি টেনিস বলও। তার উপর স্টাম্প বানাবার দায়িত্ব পড়েছে। সে জঙ্গলে ঢুকে জারুলগাছে উঠে গেছে ডাল কাটছে। তিথির তখন নিচ থেকে হাজার রকমের প্রশ্ন।
গাছে উঠেছ কেন? নামো। পড়ে হাত—পা ভাঙলে কে দেখবে।
শোন তিথি সবতাতে মাতব্বরি করবি না। ভাগ এখান থেকে।
ডাল কাটছ কেন বলবে তো!
আমার ইচ্ছে, কাটব।
না কাটতে পারবে না।
তোর গাছ?
হ্যাঁ আমার গাছ। নামো বলছি। উনি অবেলায় বাবুদের কথায় গাছে উঠে গেছেন!
ডালে কোপ দিতেই তিথির চেঁচামেচি শুরু।
অ হরমোহনদাদু, দ্যাখো এসে অরুদা গাছের ডাল কাটছে।
আর তখনই হরমোহনদাদুর তড়পানি শুরু হয়ে যায়। গাছের নীচে এসে তাড়া—নামেন গাছ থেকে। কে অবলায় আপনাকে গাছে তুলে দিয়েছে। পড়ে—টরে হাত—পা ভাঙলে কী হবে?
গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটি, বড়দিনের বন্ধে তিথির শুধু অপেক্ষা বাবুদের আত্মীয়স্বজনরা কে কবে আসবে। কেউ আসার কথা থাকলেই সে দৌড়ে সবার সঙ্গে স্টিমারঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মালপত্র নামানো হয়। তিথি দেখেশুনে সব মালপত্র নামায়। ছোট তরফের বউদিমণি এলে ত কথাই নেই। সে বউদিমণির ব্যাগ—এটাচি হাতে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
বউদিমণি এলে সে কিছু পায়।
যেমন সেবারে তাকে একটা গন্ধ সাবান দিতেই কি খুশি! নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকছে। তার ঘরে ছুটে এসে বলেছে, ছোট তরফের বউদিমণি দিল। একবার মেলা থেকে পেতলের মাকড়ি কিনে দিয়েছিল বাবার বউঠান—কী খুশি তিথি। বাড়ি বাড়ি সে কানে মাকড়ি পরে ঘুরেছে।
কে দিল রে?
গিন্নিমা দিয়েছে। গিন্নিমা বলল, তিথি, মেয়েদের কান খালি থাকলে ভালো দেখায় না। পেতলের মাকড়ি জোড়া দিলাম। সব সময় পরে থাকবি। কান খালি রাখলে বাড়ির অমঙ্গল হয়।
তিথি ভালো ফ্রক গায়ে দিলে, স্নো পাউডার মাখলে সবার এক প্রশ্ন—কে দিল?
অকপটে তিথি সব বলে দিত, কে কখন ডেকে তাকে কী কী দিয়েছে।
তিথির সঙ্গে তার যে দু—একবার হাতাহাতি হয়েছে, তাও আজ কেন যে মনে পড়ল!
সেই যে বছর সে এখানে চলে আসে, বোধ হয়, সেবারেই হবে। তখনও সবার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তিথির মামা, তার সমবয়সিই হবে, চরণের সঙ্গে ডাংগুলি খেলার জন্য গাছের ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পেয়ারা গাছের সোজা ডাল হলে ভালো হয়। পেয়ারা গাছের ডাল ওজনেও ভারী। উৎকৃষ্ট ডাং পেয়ারা গাছের ডাল থেকেই তৈরি করা যায়। ডাল কাটার দা নিয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি করতেই সহসা তিথি উদয় গাছতলায়। চেঁচাচ্ছে—ও বৃন্দাবনদা, পেয়ারা গাছের ডাল কাটবে অরুদা। গাছের নীচে ঘুর ঘুর করছে।
মারব এক থাপ্পড়। আমি ডাল কাটব, তোকে কে বলেছে?