জীবনমৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিথির এ কী খেলা! জঙ্গল থেকে তার হাত ফসকে গেলেই তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। জলের ঘূর্ণি এখানটায় প্রবল। দুর্যোগের মুখে স্টিমার পর্যন্ত জায়গাটা এড়িয়ে চলে। যতই সে নদীকে চিনুক, এই প্রবল ঘূর্ণিতে সে হাত ছেড়ে দিলেই জলের নিচে খড়কুটোর মতো তলিয়ে যাবে।
তিথি কি তার শেষ কথা তাকে বলার জন্য অপেক্ষা করছে? তা হলে ফেললেই আর তার মরার ভয় থাকবে না?
সে দাঁড়িয়েই আছে।
তিথি স্রোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সে লাফিয়ে জলে নেমে যেতে পারছে না। নামার সময় মাটি ধসে যেতে পারে। মাটি ধসে গেলেই ঝোপজঙ্গলসহ তিথি আবার তলিয়ে যাবে।
সে চিৎকার করে বলল, আমি আর পারছি না। তোর আর কী কথা আছে বল! আমাকে আর কত আতঙ্কে রাখবি?
অরুদা তুমি তুলিদিকে কিন্তু কখনও স্বপ্নে দেখবে না। কথা দাও।
অরণি হাসবে না কাঁদবে না ভয়ঙ্কর বিরক্তিতে চুল ধরে জল থেকে তুলে আনবে বুঝতে পারছে না। সে মুখ খিঁচিয়ে বলতে গিয়ে ভাবল, তা হলে আর এক বিড়ম্বনা শুরু হবে। হয়তো সত্যি হাত ছেড়ে দিয়ে তিথি নদীর অতলে মৎস্যকন্যা হয়ে ঘুরে বেড়াবে।
আর আশ্চর্য, তার কথারই প্রতিধ্বনি যেন করছে তিথি। বলছে অরুদা আমি তো অন্য জন্মে নদীতে মৎস্যগন্ধা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এ—জন্মে তিথি হয়ে জন্মেছি। তুমি তো কিছুই জানো না।
কত নিশ্চিন্তে এমন কথা বলছে, তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখে পড়ে গিয়ে, ঠিক পড়ে গিয়ে নয়, যেন কোনও আত্মবিনাশের প্রবণতা থেকে মেয়েটা তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে।
সে আর পারছে না। বলল, ঠিক আছে, সাবধানে উঠে আয়। নে, বলে সে গামছার প্রান্তভাগ ছুঁড়ে দিল তিথির দিকে। তিথি ইচ্ছে করেই যেন ধরল না। এমনকি চেষ্টাও করেও দেখল না, গামছাটা ধরা যায় কিনা।
শুধু বলল, কী দেখবে না তো?
না, দেখব না।
তুমি আমাকে স্বপ্নে না দেখলে তুলিদিকেও স্বপ্নে দেখবে না।
দেখব না, দেখব না।
তিন সত্যি।
তিন সত্যি।
তারপরই তিথি জলের ঘূর্ণিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আট
শেষে অবশ্য তিথিকে খুঁজে পাওয়া গেল ইলিশ মাছের নৌকায়। জেলেরা টের পেয়েই জলে লাফিয়ে পড়েছিল।
তারপর সেই দুর্যোগের মধ্যে তিথিকে নিয়ে বাড়ি আসতে পেরেছিল ঠিক, তবে সেদিনই জ্বরে পড়ে গেল অরণি। জ্বর বাড়ল। বাবা বাড়ি নেই—তিনদিনের মাথায় বুকে কফ জমে গেল—কবিরাজ অমূল্যধন, এলাকার ধন্বন্তরি, তিনি বলে গেলেন, সান্নিপাতিক জ্বর—ভোগাবে।
অরণি প্রায় মাসখানেক বিছানায় পড়ে থাকল। এত দুর্বল হয়ে গেল যে প্রায় উঠতে পারে না। বিছানায় লেগে আছে। বাবা ফিরে এসে খুব প্রমাদ গুণলেন। তিথি বলতে গেলে সারাদিন তার ঘরেই পড়ে থাকে। সেবা—শুশ্রূষারও শেষ ছিল না। বাবাই তিথিকে অনুপান—সহ কখন বড়ি মেড়ে খাওয়াতে হবে বলে দিয়েছেন। যেমন বাসকপাতা, তুলসিপাতা, মধু এবং পুনর্ণবার পাতা তিথিও ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করত। একেবারে একজন শিশুকে যেভাবে পরিচর্যা করা দরকার, তিথি তাকে সেভাবেই অতি যত্নে বিছানা থেকে তুলেছে, কপালে জলপট্টি দিয়েছে, এবং তিথি যে কত দায়িত্বশীল তার এই পরিচর্যার বহর না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। তার আরোগ্য কামনায়, সে সেই জঙ্গলের মন্দিরগুলিতে মাথা ঠুকে এসেছে, মানত করেছে, অরুদা ভালো হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে যাবে। বাতাসা মিসরিভোগ দেবে।
বিকেলের দিকে বাবুরা আসতেন। বাবা ক’দিন ঘর থেকে বেরই হলেন না। জেঠিমা, তুলিও তাকে দেখে যায়। ছোট পিসি ঘরে ঢোকেন না। বাইরে থেকেই, মুখ বাড়িয়ে বলবেন, মুখে তোর রুচি কীরকমের?
তার খাওয়ায় রুচি ফিরে এলে বলেছিলেন, আর ভয় নেই। এবার ভালো হয়ে উঠবি। আর ভয় নেই। তিথির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটা তোর জন্য যা করেছে!
তিথি এসব কথায় খুবই লজ্জায় পড়ে যেত। টিপয়ের গেলাসে জল রেখে দিত ঢাকনা দিয়ে। বেদানার খোলা ছাড়িয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিত। প্রথম পথ্যের দিনে হেলানচার ডগা সেই তুলে এনেছে। জঙ্গল থেকে গন্ধপাঁদাল। মৌরলা মাছ দিয়ে গন্ধপাঁদালের ঝোল পথ্য। তিথিই তাকে ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে এল একদিন। কাছারিবাড়ির বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার পেতে বলেছিল, আমার জন্য এই ভোগান্তি। কিছু হলে আমার যে কী হত! আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারতাম না। বলেই ফুঁপিয়ে তার কি কান্না।
কাঁদছিস কেন? আমি তো ভালো হয়ে গেছি। অরণি বলত।
তিথি তখন তার কথায় জবাব না দিয়ে পালাত। সে দেখতে পেত তিথি সুপারিবাগানে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যেন এক দিশেহারা কিশোরী—সে শুধু দেখত। জোরে আর ডাকতে পারত না।
তিথি বড় সুন্দর দেখতে।
অরণি সুপারিবাগানের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবছিল। চুল কোঁকড়ানো। চোখ টানা টানা—গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। নাকে নথ ঝুলিয়ে দিলে দুগ্গা ঠাকুর।
সে জানে ভেতর বাড়িতে তিথি ফুটফরমাস খাটতে ভালোবাসে—তিথি গামছাটা নিয়ে আয়, তিথি দ্যাখ বৃন্দাবনদা এল। ভাঁড়ার থেকে চাল, ডাল বের করে দে। ভেতর বাড়িতে দাদাদের সঙ্গে গেলে এমন কত কথা শুনতে পেত অরণি। বাজার থেকে ঝুড়ি ভর্তি সওদা এলে ফ্রক গুটিয়ে ছোট পিসির সঙ্গে বাজার গোছাত। কোথায় কী রাখতে হবে তিথি ঠিক জানে। কখনও বীণাপিসির সঙ্গে মাছ কুটতে বসে যায়—ঘাট থেকে কাটা মাছ ধুয়ে আনে। কোচরে থাকে থোকা থোকা লটকন ফল। ফাঁক পেলেই খোসা ছাড়িয়ে খায়। তার ঘরে এসে তাকেও দেয়।