তুমি কথা রাখো না। আমার গা ছুঁয়ে বলেছ, আমার সঙ্গে নদীতে যাবে। ফিরে গেলে আমার আর কতটা ভালো হবে?
কতটা ভালো হবে জানি না। তবে তুই এলে পরামর্শ করা যাবে। তুই না থাকলে তুলি আমাকে নিয়ে যা খুশি ইচ্ছে করবে। তোর ভালো লাগবে?
এতেই যেন জব্দ। তিথি পাটাতনে বসে পড়ল। পাড়ের দিকে আসার চেষ্টা করছে।
সে কোমর জলে নেমে গেল। তারপর সাঁতার কাটতে থাকল। নৌকার কাছে গিয়ে ঝুঁকি মেরে পাটাতনে উঠল। এবং বৈঠা আর তিথির হাতে রাখল না। সে প্রায় জোর করেই কেড়ে নিল।
তিথি তুই আমাকে নিয়ে কোথায় যেতে চাস বল। আমরা কতদূর যেতে পারি। মাথা খারাপ করে লাভ আছে!
আমি কী করব অরুদা, তিথি কেমন পাগলের মতো হা—হুতাশ করছে।
অরণি ঠিক বুঝতে পারছে না, তিথি এত ভেঙে পড়েছে কেন! তিথির কি কোনও দুঃসংবাদ আছে—অথবা কোনও এক অতিকায় হাঙরের পাল্লায় পড়ে গেছে তিথি! তার বিয়ের কথা কি পাকা হয়ে গেছে!
তবু তার কেন জানি হাঙরের কথাই মনে পড়ল। তিথিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে।
সেজদা কিংবা জমিদারবাড়ির আর কেউ। তিথির শরীরে লাবণ্য এত বেশি, যে—কেউ যেন তিথিকে দেখলে মোহিত হয়ে যাবে।
সে ডাকল, তিথি।
বলো।
তোর কিছু হয়েছে?
কী হবে?
আচ্ছা আমাকে নিয়ে তুই কোথায় পালিয়ে যেতে চাস?—
তা তো জানি না।
আজকে কী মতলব ছিল তোর?
কী যে ছিল, বলতে পারব না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখো না, আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখি—ভাবলে যে মন খারাপ হয়ে যায়।
স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?
তিথি মাথা নিচু করে বসে থাকল।
বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। সঙ্গে দামাল হাওয়া। হালকা কোষা নৌকাটি সহজেই উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে জলের নিচে বৈঠা ঢুকিয়ে হাল ধরেছে। ইচ্ছে করলেই হাওয়ার উপায় নেই নৌকা উড়িয়ে নেয়। বরং হাওয়ার গতির জন্য নৌকা পাড়ের দিকে ভেসে যাচ্ছে। এত ঘন বৃষ্টির ছাট যে এখন পাড়ও ভালো করে দেখা যায় না। তবে সামনের বাঁশের জঙ্গল বিশেষ করে স্টিমারঘাটের বয়ার আলো দুলছিল বলে সে জানে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে নদীর অন্য কোনও মোহনায় হারিয়ে যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর তীর পেয়ে যাবে।
কী চুপ করে থাকলি কেন, স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?
তিথি বলল, তুমি তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দ্যাখো না?
না।
কাউকে দ্যাখো না।
কাউকে দেখব না কেন। আর স্বপ্নের কথা কি মনে থাকে। কত কিছুই দেখি, ঘুম থেকে উঠে আর মনে করতে পারি না। আমার কী দোষ বল।
আমাকে স্বপ্নে দেখলে তুমি ভুলে যেতেই পারো না। ঠিক তোমার মনে থাকত।
তা অবশ্য বোধহয় থাকত।
বোধহয় না। থাকত।
ঠিক আছে, আয় আমরা এসে গেছি। নাম।
তুমি তো বললে না, কবে তুমি স্বপ্নে আমাকে দেখবে!
তিথির কাছে এই মুহূর্তে কোনও মিছে কথাও বলতে পারছে না। সে বলতে পারত, নারে, আমি তোকে স্বপ্নে দেখি, তবে বলতে লজ্জা হয়। তুই না আবার কী ভাবিস! মিছে কথা বললে, তিথি সহজেই তাকে বিশ্বাস করবে। নিছক একটা স্বপ্ন নিয়ে তিথির কাতর মুখ সহজেই উচ্ছল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু তিথির কাছে কিছুতেই মিছে কথা বলতে মন সায় দিল না।
শোন অরুদা। স্বপ্ন কখন দ্যাখে জানো?
না, জানি না।
সারাদিন যাকে ভাববে, রাতে সেই স্বপ্নে হাজির হয়, জানো?
অরণি বলল, হতে পারে।
হতে পারে না। হয়। আমি তো প্রায়ই তোমাকে দেখি। সেই এক দৃশ্য, আমি ডুবে যাচ্ছি, তুমি আমাকে জল থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছ। ভাবতে গেলেই আমার শরীর কেমন শিউরে ওঠে। এই দ্যাখো, দ্যাখো না, আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে গেছে! স্বপ্নটা ভাবতে গেলেই শরীর অবশ হয়ে যায়।
শিগগির নাম।
নৌকাটা খুবই দুলছিল। নৌকাটাকে আয়ত্তে রাখাই কঠিন। যেন পাড়ে এসে ডুবে যাবে। সে লাফিয়ে কোমর জলে নেমে গেল। নৌকাটা একটা গাছের গুঁড়িতে বেঁধে ফেলল।
এই নাম। ঠান্ডায় হাত—পা অবশ হয়ে আসছে।
নামব না।
তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস?
তখনই পাড়ের দুটো গাছ অদূরে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে জলে পড়ে গেল। স্রোতে গাছ দুটো ভেসে যাচ্ছে। কোথা থেকে উড়ে এল দুটো বক। ভাসমান গাছের ডালে বসে পড়ল। এক সময় মনে হল এই দুর্যোগ থেকে তিথিকে কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না। সেও ভেসে যেতে পারে। নদীর এমন ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপ সে যেন জীবনেও দেখেনি। সে ইচ্ছা করলে আত্মরক্ষার্থে তিথিকে ফেলে চলে যেতে পারে—তিথি যা খুশি করুক। কিন্তু তিথিকে ফেলে যাওয়ার যে তার ক্ষমতাই নেই। মরে গেলেও তিথিকে নিয়েই মরে যেতে হবে।
সে না বলে পারল না, কী হল বসে থাকলি কেন? দ্যাখ কী অবস্থা। বুঝতে পারছিস না। দুর্যোগ সব গাছপালা উড়িয়ে নিতে চাইছে। তুই কী মরতে চাস!
তিথি পাটাতনে উঠতে গিয়ে নৌকার দুলুনিতে টাল সামলাতে পারল না। জলে পড়ে গেল। নৌকার কিনার ধরে ফেলায় স্রোতের মুখে ভেসে গেল না ঠিক, তবে কেমন অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। নৌকার কিনার ধরে সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালে তিথি জলের মধ্যে সহসা অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিথি! তিথি!
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো শুধু চিৎকার করছে, তিথি! তিথি!
মুহূর্তে মনে হল তিথি অদূরে ভেসে উঠেছে জলের ওপরে। জন্ম থেকে সে এই নদীকে চেনে। নদীর ক্ষমতাই নেই তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। সে ভুস করে জলে মুখ দেখিয়ে আবার ডুবে গেল! আবার কিছুটা দূরে চলে যাচ্ছে, আবার ভুস করে ভেসে ওঠে তার মুখ দেখাচ্ছে। সে পাড়ে পাড়ে ছুটে যাচ্ছে। সে চিৎকারও করতে পারছে না, তিথি জলে ডুবে যাচ্ছে। জলে ডুবে যাচ্ছে না, তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে মজায় মেতেছে, তখনই তিথি পাড়ের জঙ্গল আঁকড়ে তাকে ডাকছে—অরুদা, আমি এখানে। সে দৌড়ে কাছে গেলে বলল, একটা কথা বলব?