খুবই বিব্রত হয়ে পড়ল সে।
তিথি তোর গা গরম! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস!
যা ভাগ! আমার কিছু হয়নি।
এতই ঘনবর্ষণ যে দু—দশ হাতের কাছাকাছি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন এক আচ্ছাদন চারপাশে তাদের ঘিরে রেখেছে। এমন মুহূর্তে তার ইচ্ছেই করছে না তিথিকে ফেলে যেতে। কাছারিবাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে—কিন্তু তিথি তার বুক থেকে কিছুতেই মাথা তুলছে না।
জানো, তোমাকে আমার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখ?
এমন প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে! সে কখনোই তিথিকে স্বপ্নে দেখেনি।
সে বলল, না।
বা তা হয় নাকি! ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয় জানো!
তুই দেখিস?
হ্যাঁ, দেখি। কত রাতে স্বপ্নে দেখেছি, আমি নদীর জলে ডুবে যাচ্ছি, পাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছ তুমি—দু হাতে চুলের ডগা ধরে তুলে আনছ। তারপর পাঁজাকোলে করে…
পাঁজাকোলে করে… কী?
কী আবার, ধ্যাত, আমার লজ্জা লাগে। শুনতে খুব ভালো লাগে… পাঁজাকোলে করে কী… এখন বলব না। পরে বলব।
তারপর বৃষ্টির মধ্যেই সে দৌড়ে সুপারিবাগানের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়!
মাঝে মাঝে তারও কী যে হয়!
মাথা কান গরম হয়ে যায়। চোখ মুখ ঝাঁঝাঁ করে।
পরের বর্ষায় তিথি সত্যি একদিন হাত ধরে টানতে টানতে নদীর পাড়ে গেছিল। সেদিনও অবিশ্রান্ত বর্ষণে পৃথিবী যেন কুহেলিকাময়। ঝাপসা কুয়াশার মতো বৃষ্টির আড়ালে তারা যে নৌকায় উঠে বসেছে কেউ দেখতেই পায়নি। বাবা সেদিনও কাজে বাইরে গেছেন। ফিরবেন দুদিন বাদে। রাতে তিথি এখন তার ঘরে পাহারায় আর থাকে না। তিথির মামা চরণ রাতে তার ঘরে শোয়।
বাবাই কেন যে সেবারে বললেন, তিথির এখন সমন্দ আসছে। গোরাচাঁদ যাকে দেখছে, বলছে, কন্যে উদ্ধার করে দিন। তিথির মামা চরণ তোমার ঘরে শোবে। তিথির আর তোমার ঘরে শোওয়া ঠিক হবে না। আমিই তিথিকে বারণ করে দিয়েছি।
তিথির বিয়ে! যা হয় নাকি! কতটুকুন মেয়ে—বড় না হলে মেয়েদের বিয়ে হওয়া মানায় না।
সে তিথিকে ডেকে বলেছিল, কী রে তোর বাবা নাকি পাত্র খুঁজছে?
ধুস, তুমি যে কি না। আমি বড় হয়ে গেছি না! তাই তোমার ঘরে শুলে কেউ খারাপ কিছু ভাবুক কাকা চায় না। আমার পাত্র দেখা হচ্ছে, আমি জানব না!
এও হতে পারে, মেয়ে বড় হতে থাকলে বাপের চিন্তা বাড়ে। হয়তো বাবাকেই ধরতে পারে, কোনও সুপাত্র যদি জোগাড় হয়। সুন্দরী মেয়ের পাত্রের অভাব হয় না। কিন্তু যা হয়, এসব ভাবলেই খুব মুষড়ে পড়ে অরণি।
তিথি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে সে না গিয়ে পারে! তিথি যে কী সুঘ্রাণ ছড়িয়ে রেখেছে—তিথির কাছে থাকলে তার শরীরে যে সুবাতাস বয়—তার সাধ্য কি তিথিকে ফেরায়!
চালতে গাছের নিচে তাপ্পিমারা কোষা নৌকাটা দড়িতে বাঁধা ছিল। পাটাতনের নিচে বৈঠা। একটা লগিও আছে। বৃষ্টিতে পাটাতনের নিচে জল জমে গেছে—তিথি উবু হয়ে বসল। জল সেঁচে ফেলছে—তিথির দুই উরুর দিকে কিছুতেই তাকাচ্ছে না অরণি, যদি কিছু দেখে ফেলে।
সহসা কেন যে অরণির মনে পড়ে গেল তিথি তাকে ফের হয়রানি করতে পারে। নদীতে তাজা ইলিশ দেখাবার নাম করে তাকে নিয়ে গিয়ে শেষে কোথায় ফেলবে জানে না। তিথির যদি কোনও দুষ্টবুদ্ধি কাজ করে, সারা সকাল—দুপুর রোদের সেই হয়রানির কথাও মনে পড়ল।
মুশকিল তিথি কোথায়, কী করছে, দেখার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। তিথি বাড়ি না থাকলে ধরেই নেয় সে বাবুদের রান্নাবাড়িতে আছে, নয়তো তুলির ঘরে, ছোটপিসির ঘরেও থাকতে পারে। কিন্তু তার ওপর বাবুদের বাড়ির সবারই কমবেশি নজর আছে। সেজদা কিংবা সোনাদা কাছারিবাড়িতে এসে উঁকি দিতে পারে, তাছাড়া দুপুরেও তাকে রান্নাবাড়িতে হাজির থাকতে হয়। সে না গেলেই কার নির্দেশে যে ভেতরবাড়িতে তোলপাড় পড়ে যায়—সে তিথির সঙ্গে এই দুর্যোগে কিছুতেই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিতে পারে না।
নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে এল অরণি।
তার খালি গা। প্যান্টের ওপর কোমরে গামছা জড়ানো। সে নদীতে ডুব দিয়ে বলল, এই তিথি বাড়ি চল। যেতে হবে না।
কেন, গেলে কী হবে?
ফিরতে দেরি হয়ে গেল সবাই ভাববে।
ফিরতে দেরি হবে কেন? জাল থেকে পাটাতনে যখন ফেলে, ইলিশ মাছ কী লাফায়! তারপর মরে যায়। মাছের মরে যাওয়া দেখবে না!
আচ্ছা তিথি মাঝে মাঝে তোর এত বাই চাপে কেন বল তো! মাছের মরে যাওয়া দেখার মধ্যে কোনও আনন্দ আছে?
তিথি আর কথা বলল না। সে পাড় থেকে নৌকা ঠেলে পাটাতনে লাফিয়ে উঠে গেল। কী যে করে তিথি! নদীর দু’কূল দেখা যায় না।
ভরা কোটাল। প্রবল স্রোতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চরের কাশবন সব ডুবে গেছে। সামনে নদীর এত বড় চড়া অদৃশ্য—মনে হয় নদী ফুলে ফেঁপে দু’পাড় ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। মাঝগাঙে মেলা জেলে নৌকা পর পর, খড়ের নৌকাও মেলা। গয়না নৌকার মাঝি গুণ টেনে স্রোতের বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন বড় বেশি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে। সারা আকাশে মেঘ আর বজ্রবিদ্যুতের ছড়াছড়ি।
এই কি, তিথি সত্যি বৈঠা মেরে মাঝগাঙে চলে যাচ্ছে!
সে চিৎকার করে ডাকল তিথি যাস না। গেলে ভালো হবে না। আকাশ তোর মাথায় ভেঙে পড়বে।
তিথি পাটাতনে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ভালো দিয়ে তোমার কী হবে?
হবে। তুই ফিরে আয়। তুই ফিরে এলেই হবে।