এত বড় ঘরটায় তার ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। অবশ্য খুবই ঠান্ডা লাগছে। কাঁথা গায়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তেও পারে। বই খাতা নিয়ে বসতে পারে। চলিত নিয়মের কিছু অঙ্ক করা বাকি। কিন্তু যা দুর্যোগের ঘোর চলছে, তাতে হারিকেন জ্বেলে না দিলে কিছুই দেখা যাবে না। বৃষ্টি ধরে আসতেই সে বের হয়ে পাঁচিলের দিকে যাওয়ার সময় দেখল তিথি পা টিপে টিপে তার ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছে। তিথি কিছু বলতে চায়।
মানুষ সমান পাঁচিলের এপাশে সে ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে তিথি তেমনি তার গা ঘেঁষে হাঁটছে। তার কনুইয়ে তিথির নরম স্তনের সামান্য আভাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার ভালো লাগছিল। তিথি কী যে চায়, তার ছাতার নিচে ঢুকে তার সঙ্গে কাছারিবাড়িতে উঠে যেতে পারে, কিন্তু তিথি আজকাল তার ঘরে একা ঢোকে না—যেন তিথি খুবই সতর্ক হয়ে গেছে। তার মনে পাপ আছে, সে কিছু যদি করে বসে, এসবও ভাবতে পারে। নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করার চেষ্টাতেই যেন বলল, যা বাড়ি যা।
বাড়ি যাব কি! তুমি তো আমার কথাই শুনলে না।
আবার কী কথা!
বারে বললাম না, আরও কথা আছে।
আবার বোধহয় ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে! সে ছুটতে চাইলে ছাতার ডগা ধরে ফেলল তিথি।
কী যে লাফাচ্ছ না! জলে সব ভিজে যাচ্ছে।
চারপাশে জল জমে যাওয়ায় ইচ্ছে করলেই ছুটে যাওয়া যায় না।
বকের মতো পা ফেলে হাঁটতে হয়। তিথির আরও কথা আছে, কিছুতেই এই বৃষ্টির মধ্যে না শুনিয়ে ছাড়বে না। অথচ দু’জনেই ভিজে যাচ্ছে।
তুমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলবে না।
কী বলব না।
এই যে তুলিদি তোমাকে চুরি করে দেখে। তুলিদি সব লক্ষ্য রাখে জানো। কী বলল জানো, দেখিস অরুর আর কদিন বাদেই গোঁফ উঠবে।
সে বলল, তাই বুঝি।
আমাকে বকল। তুই একা ঘরে যাস লজ্জা করে না। দামড়া হয়ে উঠছে জানিস না!
এসব কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না।
আর যাবি না একা। খবরদার। একা গেলে ছোটপিসিকে বলে দেব। হুমকি।
এসব শুনতে ভালো লাগছিল না তার।
ঠিক আছে। চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। না হলে সব তোর ভিজে যাবে।
যাক, গোঁফ উঠলে দামড়া হয়ে যায় একথা কি ঠিক?
জানি না।
তুমি তো কিছুই জানো না। আর ক’দিন বাদে তোমার গোঁফ উঠবে, তুলিদি জানে, অথচ তুমি জানো না। যার গোঁফ সেই ঘুমিয়ে থাকে। আয়নায় দেখে তো বুঝতে পারো, না তাও বোঝ না। তুমি কী বোঝ বলো তো!
তিথির কথা এমন যে মায়া না জন্মে পারে না। তিথি না থাকলে সে কত একা তাও বোঝে। বড় হওয়ার মুখে তিথির সাহচর্য তার চারপাশ ভরে রেখেছে। সে না থাকলে তার যে সবই অর্থহীন হয়ে যেত, সে অতিষ্ঠ হয়ে হয়তো চলেই যেত। একা এমন দূর দেশে মাকে ছেড়ে এভাবে কারও পক্ষে থাকাই সম্ভব হত না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাকে বলে সে তিথির জন্য ভালো ফ্রক প্যান্ট আনিয়ে দেবে। কিন্তু সে বলে কী করে! তিথির প্রতি তার আকর্ষণ যদি বাবা টের পেয়ে যান!
সে এত নিরুপায় যে তিথিকে কোনও কারণেই সামান্য ভর্ৎসনা পর্যন্ত করতে পারে না। তিথির পক্ষে তার ঘরে একা আসা উচিত নয় সেও এটা বোঝে। তুলির চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন।
তারপরই তিথি বলল, মনে আছে তো! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি আমাকে কাচের চুড়ি কিনে দেবে, মনে নেই!
দেব।
তারপরই তিথি কেন যে সহসা বলল, আমি যাই। নদীতে বান এসে গেছে, কী মজা হবে না! তুমি যাবে?
কোথায়?
নদীতে।
কেন?
বারে নৌকায় ভেসে যাব আমরা। তারপর নৌকা যেখানে যায় যাবে। আমরা বসে থাকব। হাটবারে বাবা গাওয়ালে যায় না। নৌকাটা নদীর পাড়ে পড়ে থাকে। যাবে আমার সঙ্গে?
না।
কেন যাবে না? আমি কী করেছি! আমার সঙ্গে গেলে তাজা ইলিশ দেখাব। ঝকঝকে রুপোর ইলিশ। লাফাচ্ছে, পাটাতনে লাফাচ্ছে।
তিথির পক্ষে সবই সম্ভব। গেছো মেয়ে, ভালো বৈঠা চালাতে পারে, আর বর্ষায় নদীর জলে স্রোতের মুখে সাঁতরাবার সময় কখন যে শুশুক মাছ হয়ে যায়, কখন যে জলের নিচে ডিগবাজি খায়, দূর থেকে কখনোই মনে হয় না তিথি জলে সাঁতার কাটছে, জলে ডিগবাজি খাচ্ছে, যেন নদীর জলে নেমে মৎস্যগন্ধা হয়ে গিয়ে কোনও সুপ্রাচীন কাব্যগাথা তিথি। সে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখত। ভরা কোটালে মাঝনদীতে যাওয়ার সাহসই নেই তার। ঘোর বর্ষায় নদীর জলে ঘূর্ণি দেখলেই তার মাথা ঘোরায়। তিথি কিছুই গ্রাহ্য করে না। তাকে তাজা ইলিশমাছের প্রলোভনে ফেলে দিচ্ছে। সে যেন এবার তাকে নিয়ে নদীতে ভেসে যাবেই। তাজা ইলিশ তাকে জেলেদের নৌকায় দেখাবেই।
মানবাজারের ওদিকে মেলা মন্দির আছে। বিশ্বনাথের মন্দির, কালভৈরবের মন্দির, রুদ্রদেবের, অন্নপূর্ণার মন্দির। ওদিকটায় তখন ঘন জঙ্গল। অষ্টমী স্নানের মেলায় জমিদারবাবুরা লোক লাগিয়ে জঙ্গল সাফ করে দেয়। ওখানেই তো মেলা বসে। কাচের চুড়ি ওখানেই কিনতে পাওয়া যায়।
তিথির সঙ্গে থাকার এই মুশকিল। কিছুতেই তার কথা শেষ হয় না। তাকে রাজি না করিয়ে যেন তিথি কিছুতেই যাবে না।
সে কেমন প্রলোভনে পড়ে গিয়ে বলল, ঠিক আছে যাব। হাটবার আসুক।
ঠিক যাবে?
হ্যাঁ, ঠিক যাব।
তিন সত্যি।
তিন সত্যি।
আমার গা ছুঁয়ে বলছ!
এই গা ছুঁয়ে বলছি।
তিথি এতই আপ্লুত তার কথায়, প্রায় বুকের কাছে মাথা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
ঘনবর্ষণে দু’জনেই ভিজে যাচ্ছিল। তিথি কি এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে চায়! তিথির শরীরে কি উত্তাপ জমা হচ্ছে! বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিলে কেন যে মনে হয়েছিল, তিথির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।