তিথি ঠিক করবী গাছটার নিচেই ফিসফিস করে বলল, এই একটা কথা বলব?
একটা কথা বোধ হয় আর শেষ হবে না।
কী বলবি?
বলো রাগ করবে না।
রাগ করার কথা হলে মানুষ রাগ না করে পারে?
তা হলে তো বলা যাবে না। তুলিদি যদি জানতে পারে আমাকে খেয়ে ফেলবে।
বাবুদের বাড়ির মেয়ে। এখন সে আরও লম্বা ফ্রক পরে। তাকে দেখলে আড়ালে চলে যায়—তুলির খুব আজকাল লজ্জা। তিথি বলল, আগে তুমি তুলিদিকে চুরি করে দেখতে, এখন তুলিদি তোমাকে দেখে।
তুলি বলল তোকে!
আমাকে বলবে কেন। তুলিদির চাওনি দেখলেই সব বোঝা যায়।
এই কথা!
আজ্ঞে না। এই কথা না। আরও কথা আছে।
কী কথা, শোনার কোনও আগ্রহ বোধ করল না সে। বাবুদের মেয়ে, কত রকমের শখই থাকে। মেজদা শহর থেকে একটা সাদা রঙের বাচ্চা কুকুর এনে দিয়েছে। খরগোশের চেয়ে সামান্য বড়। কুকুরটা আর বড় হবে না। তুলি বিকাল হলেই পরীর মতো সেজে গুজে কুকুরটা বুকে নিয়ে কাছারিবাড়ির বাগান, না হয় নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। তার জানালা থেকে যতটা দেখা যায় ততটা রাস্তাতেই তুলি হাঁটাহাঁটি করে। বেশি দূরে যায় না। কখনও বীণা পিসি থাকে, কখনও থাকে না।
পাঁচিলের দরজা দিয়ে ঠিক ভেতরে ঢোকার মুখেই তিথি ছিটকে ছাতার তলা থেকে সরে যাওয়ার সময় বলল, তুমি তো শুনতে চাইলে না পরে বলব।
এক ছাতার তলায় তিথিকে এত ঘনিষ্ঠ দেখলে তুলি কি খেপে যাবে! তিথির ছিটকে যাওয়া দেখে এমনই মনে হল তার। এবং আজকাল তার যা হয় সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। তিথি জলে কাদায় চিত হয়ে পড়ে আছে। তিথিকে না দেখে কেন যে তুলিকে দেখতে পেল—ঠিক একইভাবে জলে কাদায় তুলি চিত হয়ে পড়ে আছে।
এসব কেন যে সে দেখে!
রোয়াকে উঠে এক কোনায় সবার সঙ্গে সেও ছাতা রেখে হেঁটে গেল। লম্বা কার্নিসের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রান্নাবাড়ির এলাকাটা বাড়ির ভেতর মহল পার হয়ে। সবাই এসে গেছে—সে এদিক—ওদিক চোখ তুলে তাকায় না। মাথা নিচু করে হাঁটার স্বভাব। চোখ তুললেই যেন, জানালার পাশে কিংবা খাটের বাজুতে দেখতে পাবে তুলি থুতনি রেখে তাকে দেখছে।
অবশ্য তুলি বের হবেই। সে না দেখলেও বের হবেই।
কারণ তার কুকুরটা কী শুঁকতে শুঁকতে রোয়াকে বের হলেই তুলি ছুটে আসবে। একবার পলকে তাকে দেখে কুকুরটাকে বুকে করে তুলে নিয়ে যাবে। তাকে দেখার জন্য তুলির এই ছলনায় সে ভেতরে ভেতরে মজা পায়। তুলি মনে করে সে কিছু বোঝে না।
দুর্যোগের দিনে আজ রান্নাবাড়িতে খিচুড়ি লাবড়া বেগুনভাজা চাটনি দিয়ে সবাই বেশ হুঁসহাস করে খেল। ছোড়দার থালায় খিচুড়ি থেকে গেছে। চাটনি দিতে এলে, ছোড়দা খিচুড়ি পাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইলে জেঠিমা হা হা করে উঠলেন।
ফেলিস না। তিথি খেয়ে নেবে। খেতে পেলে খুশি হবে।
এসব দেখার অভ্যাস তার আছে। পাতে তার কিছুই বেশি হয় না। বেশি হলেও খেয়ে নেয়। না খেলে তিথির জন্য তুলে রাখা হবে। ভেতরে তখন তার বড় কষ্ট হয়। তিথিকে এ নিয়ে শাসনও করা যায় না। তার বাপের যা অবস্থা, বর্ষাকাল বলে অবশ্য তার বাবা ফুলুরি, জিলিপি ভাজার দোকানটায় বসে না। নদীনালার দেশ, বর্ষায় তিথির বাবা একটা ভাঙা কোষা নৌকায় গাওয়াল করতে বের হয়ে যায়। পান, সুপারি, ছোলা, মটর, বিস্কুট, ময়দার কড়ি ভাজা নিয়ে বের হয়। ঘাটে ঘাটে পাটের বদলে গ্রাহকদের ছোলা মটর বিস্কুট দেয়। বাড়ির বউ—ঝিরা চুরি করে পাট দিয়ে জিলিপিও কেনে। এতে তিথির বাবার পড়তা অনেক বেশি পড়ে। এসময় তিথির মা বাবা ভাইবোনগুলি পেট ভরে হয়তো খেতেও পায়। কিন্তু তিথির যখন এক জায়গায় ব্যবস্থা আছে, তখন তার জন্য যেন ভাবার দরকার নেই। তিথির মা যে তার বাবার দ্বিতীয়পক্ষের, তা বোধহয় সে ভুলেই গেছে। সে তার মাকে সবসময় বড় লক্ষ্মীমতী ভাবে। মার জন্যই বাবা বিবাগী হয়ে যায়নি, সোজা কথা!
নদীনালার দেশ। পোকামাকড়ের উপদ্রব আছে। বর্ষায় তিথির বাবার ভাঙা নৌকাই সম্বল। তাপ্পি মারা। গাবের কষ খেতে খেতে পোড়াকাঠের মতো হয়ে গেছে।
ওর বাবার রাতে ফিরতে দেরি হলে নদীর পাড়ে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিথি উসখুস করলেই সে টের পায়—কিছু একটা হয়েছে।
তিথি বলবে, বাবা ফেরেনি। একা সে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পায়। ভয় পায়, না, সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভয়ের ছলনা, সে ঠিক বুঝতে পারে না। সে সঙ্গে থাকলে কথায় কথায় তিথি হেসে গড়িয়ে পড়ে। আবার তার বাপের ফিরতে দেরি দেখলে, চোখ জলে ভেসে যায়। বাবা না থাকলে যে কেউ থাকে না।
অরণি খেয়েদেয়ে বের হয়ে দেখল, বৃষ্টি আরও ঝেঁপে নেমেছে।
জগদীশও বৈঠকখানা ঘরে বসেছেন। সেও একটা বড় টুলে বসে আছে। বাবুরা কিংবা বাবুদের ছেলেরা বাড়ির করিডর ধরে যে যার ঘরে ঢুকে গেছেন। বৃষ্টির তোড় না কমলে বের হওয়া যাবে না।
জগদীশই বললেন, একটু বসে যাও। বৃষ্টি ধরে আসুক। তারপর যাবে।
বাবা তার সঙ্গে যাবেন না, সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে বাবা নাজিরখানায় চলে যাবেন। আসলে একসময় কাছারিবাড়িটায় যে নায়েব—গোমস্তাদের ভিড় ছিল, বোঝা যায়। বাবুদের অবস্থা পড়ে যাওয়ায় কাছারিবাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কবে অরণি জানে না। কাছারিবাড়িতে শুধু তার বাবা থাকেন। পাশের ঘরটায় দলিল—দস্তাবেজে ভর্তি। পরের ঘরটায়, লাঠি সড়কি বল্লম এবং তরবারিও সে ঝুলতে দেখেছে। ঘরটায় সবসময় তালা দেওয়া থাকে। পরের ছোট ঘরটায় থাকে হরমোহনদাদু—পাইক পেয়াদা এবং বাজার সরকার যখন যা দরকার সেই কাজই করেন!