নৌকায় বাদাম তুলে দিয়েছে মাঝিরা, তিথি সাঁতরে নৌকায় উঠে গেছে। সেও। কিছুটা দূরে গিয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েছে, দু’জনেই। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে এসেছে। কখনোই মনে হয়নি সে এত সুন্দর।
তিথি ফের বলল, একটা কথা বলব?
তিথির কথা কি শেষ হবে না! তাকে কি কথার ভূতে পেয়েছে!
সে সাড়া দিল না।
তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে!
সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। কারণ সে ভেতরে ভালো নেই বুঝতে পারছে। আশ্চর্য এক কৌতূহল তিথির শরীর নিয়ে—কেমন সে ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠছে। সে জোর করে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। যেন নেমে গেলেই দু’জনের মধ্যে উষ্ণতার ছড়াছড়ি শুরু হয়ে যাবে।
তিথি নিজের মতোই কথা বলছে—তুমি তো আমাকে ভালোবাস। ভালোবাসলে জানো কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়। অষ্টমী স্নানের মেলায় গোবর্ধন দাসের দোকানে তোমাকে নিয়ে যাব। কত রকমের চুড়ি, কী রঙ, কী বাহার! কাচের চুড়ি পরতে আমার খুব ভালো লাগে।
না, সে আর পারছে না। সে উঠে বসল। চোখ জ্বলছে। মুখে ঘাড়ে জল দিতে পারলে ভালো হত।
আর তখনই তিথি উঠে হারিকেনের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। মশারির নিচে সে বসে আছে, তিথি জানে না। তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছে। আর এত অন্ধকার যে কিছুই দেখা যায় না। টর্চ জ্বেলে দেখতে পারে। জানালা খোলা—প্রকৃতির আশ্চর্য বাহার—জ্যোৎস্না উঠেছে। এবং আকাশও দেখা যায়। সে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় গাছপালা দেখার চেষ্টা করল। তিথির শরীর তাকে পাগল করে দিচ্ছে। সে কিছুতেই অন্যমনস্ক হতে পারছে না। আকাশে তারা ফুটে আছে বোধহয়। জানালায় বসে আকাশে তারা খুঁজে বেড়ালেও শান্তি পেত বোধহয়। কারণ সে আর যাই করুক, তিথির কাছে খাটো হতে পারবে না। প্রকৃতির মতোই তিথির কোনও স্থিরতা নেই। এই চঞ্চল, এই শান্ত, এই বৃষ্টি, এই রোদ। কখন দু’পাড় ভেঙে দ্রুত সব তরঙ্গের মধ্যে নদীর জলে ভেসে যাবে, কখনও জ্যোৎস্নায় চরের কাশফুলে হাওয়ায় দুলে উঠবে, তার কিছুই জানে না অরণি।
সে ধীরে ধীরে নেমে গেল। তারপর টর্চ জ্বালতেই দেখল, তিথি ঘুমোচ্ছে। সত্যি ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরে, দু’হাঁটুর মধ্যে প্রায় মাথা গুঁজে তিথি অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সে তিথিকে ছুঁতে সাহস পেল না।
সে অনভিজ্ঞ। সে কিছুই জানে না, যেটুকু করেছে ভেতরের তাড়না থেকে। শরীর স্পর্শ করার এক অমোঘ তাড়নাতেই সে চকি থেকে নেমে এসেছিল—তার কেন জানি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল, তিথির শরীর ছুঁয়ে দিলেই এক আশ্চর্য পৃথিবীতে ঢুকে যাবে এমন মনে হয়েছিল তার। তিথিকে ছুঁয়ে দেখার মতো সাহস নেই তার। ছুঁয়ে দিলেই সে অপবিত্র করে দেবে তিথিকে।
সাত
দু’কূল ছাপিয়ে এবারে নদী জলে ভেসে গেল। জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি সেই যে দুর্যোগ শুরু হয়েছিল, দিনরাত ঘনবর্ষণ, ঝোড়ো হাওয়া, আকাশে মেঘের দাপাদাপি, ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। ছাতা মাথায় দিলেও রক্ষা নেই, ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উড়িয়ে নিচ্ছে। ভেতরবাড়িতে অরণি যাচ্ছিল ছাতা মাথায় দিয়ে, তখনই দেখল তিথি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তিথিও ভিতরবাড়িতে যাবে। কিন্তু ছাতা নেই বলে কারও অপেক্ষায় আছে। তাকে দেখেই সে দৌড়ে এসে ছাতার তলায় ঢুকে গেল।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল নিজেই ডেকে বলবে, এই তুই ভিজছিস কেন! চলে আয়।
কিন্তু আজকাল সে আগের মতো তিথিকে কাছে ডাকতে সাহস পায় না।
এই যে দুর্যোগ যাচ্ছে, সে কোনওদিন স্কুলে যেতে পারে, কোনওদিন পারে না। রেনি ডেরও ছুটি থাকে, তবে স্কুল কামাই করার পাত্র সে নয়। বাতাস এতই প্রবল যে ছাতা মাথায় যাওয়া যায় না। বর্ষাকাল আসার মুখে ঋতুর এই খেপা স্বভাবের কথা তার জানা আছে। কিন্তু তিথির কী ইচ্ছে হবে বোঝা ভার।
সে ছাতার ভেতর ঢুকেই বলল, ও ভিজে গেলাম! বলে প্রায় শরীর ঘেঁষে লেপটে যেতে চাইছে।
তিথির শরীরে এত আগুন আছে, কাছে এলেই যেন পুড়ে যেতে পারে, সে যতটা পারে আলগা হয়ে হাঁটে, কিন্তু হাঁটতে দিলে তো! তিথি নিজেই ছাতা কেড়ে নিয়ে বলল, এসো। কাছে এসো। জলে ভিজে যাচ্ছ।
ছপ ছপ পায়ের শব্দ উঠছে জলে।
ভেতরবাড়িতে পাত পড়েছে এমন খবর পাওয়ার পরই সে বের হয়ে পড়েছে। বাবা নাজিরখানা থেকে সোজা চলে যাবেন। আবার খেয়েদেয়ে সোজা নাজিরখানায় যাবেন। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে দিবানিদ্রা তিনি সেখানেই সেরে নেন। তিথি আগে হলে তার ঘরে ঢুকে যেত, তাকে ডেকে নিয়ে যেত, সেই যে ভেতরবাড়ির সঙ্গে কাছারিবাড়ির দুতিয়ালি করে থাকে, কিন্তু ইদানীং তিথি একা আর তার ঘরে আসে না, সঙ্গে ওর কোনও ভাই না হয় বোন থাকে। সেই কোলে করে নিয়ে আসে, বড়দের হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে।
অরণি তখন ভেতরে ভেতরে বড় অপমান বোধ করে। সে যে রাতের অন্ধকারে তিথির পাশে গিয়ে বসেছিল, আনাড়ি বলেই কী করতে হয় জানে না, তবুও বসেছিল, বোধহয় তিথি তা জানে। বোকার মতো কিছু একটা করে বসলে তিথিরও যে মান থাকে না। সে ছোট হয়ে গেলে তিথিও বোধহয় ছোট হয়ে যাবে।
হাসনুহানার গাছের নিচ দিয়ে পাঁচিলের পাশ ধরে হাঁটছে। তিথির দেরি হয়ে গেছে, সে অনেক আগেই রান্নাবাড়িতে গিয়ে বসে থাকে! তবে ঘর থেকে বের হতে পারছিল না। ছাতা না থাকলে কী করা! ভাঙা ছাতাটি তার বাবা নিয়ে যেতে পারে। ঘরে বসে বোধহয় তিথি লক্ষ্য রাখছিল, তার অরুদা কখন মাঠ পার হয়ে ভেতরবাড়িতে যায়, এবং তাকে দেখেই বড় চালতা গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। অরুদার ছাতার নিচে ঢুকে গেলে তার রান্নাবাড়িতে যেতে অসুবিধা হবে না।