না। কামড়ায় না। বললাম তো।
মশারি না টাঙালে শুতে দেব না।
তুমি শুতে দেওয়ার কে? অযথা ঝগড়া করবে না। মশারি টাঙালে কতটা আর আব্রু থাকবে বলো! যা দেখার দেখে ফেলেছ।
কত সহজে কথাটা বলে ফেলল তিথি! এতবড় নির্লজ্জ কথা বলতে বিন্দুমাত্র আটকাল না তিথির।
সেও তেরিয়া হয়ে উঠল, কী দেখে ফেলেছি! আমি কিছু দেখিনি!
দেখেছ! মিছে কথা বলবে না। মিছেকথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকে না। রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো। হারিকেন নিভিয়ে দিচ্ছি।
না, নেভাবি না।
আলো থাকলে আমার ঘুম হয় না।
তাহলে জেগে শুয়ে থাক।
সেই ভালো। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নিভিয়ে দেব। বলে সে বালিশ টেনে চিত হয়ে শোওয়ার আগে বলল, দুগগা দুগগা। তিথির হাই উঠছে। সে বালিশে থাবড়া মেরে কীসব ঠিক করে নিল। পাকা বুড়ির মতো আচরণ। নিশুতি রাতে কতরকমের আতঙ্ক থাকে, ঠাকুরের নাম করে সেই আতঙ্ক থেকে যেন রক্ষা করতে চাইছে অরণিকে।
অরণি কিছুতেই মশারির নিচে ঢুকছে না।
কী হল, বসে থাকলে কেন!
অরণি গুম মেরে বসে আছে?
ইস আলোটা চোখে কী লাগছে! বলেই উঠে পড়ল তিথি। হারিকেনটা থামের আংটা থেকে তুলে এক কোনায় নিয়ে রেখে দিল।
ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে তিথি বলল, আলোটা একটু কমিয়ে দিলে তোমার অসুবিধা হবে?
হ্যাঁ হবে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারে শুয়ে পড়ো।
অরণি এবার তক্তপোশে উঠে সে তার বাবার মশারিটা তিথির দিকে ছুঁড়ে দিল।
নে, এটা টাঙিয়ে নে।
তুমি খেপেছ। কাকার মশারি আমি টাঙাতে পারি। কাকা জানতে পারলে কী ভাববে বলো! মেঝেতে চুপচাপ শুয়ে থাকব, তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না! তোমার মনে এত পাপ অরুদা।
পাপ কথাটা এত অশ্লীল লাগে শুনতে অরণি জীবনেও টের পায়নি। পাপ আছে তার মনে। আছে, সত্যি আছে, পাপ না থাকলে, সারাদিন সে তিথির ঘোরে পড়ে থাকবে কেন! তিথি সহজভাবেই যদি সব মেনে নেয়, নিতেই পারে, সে পড়ে গেছে কাদায় পিছলে এবং যা কিছু দেখার দেখা হয়ে গেছে, এখন আর ভেবে কী হবে! তিথি তাকে বোধহয় মনে মনে ক্ষমাই করে দিয়েছে।
সে তাড়াতাড়ি চোরের মতো মশারির ভিতর ঢুকে গেল। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠান্ডা হাওয়ায় শীত শীত করছে তার। তিথি গায়ে দেওয়ার কিছু আনেনি। তিথিকে মশায় কামড়ায় না, তিথির শীতও করে না বুঝি! মশারি কিছুতেই টাঙাল না। ভাঁজ করে বাবার বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। চাদর দিলেও হয়তো গায়ে দেবে না—বলবে, কী যে করছ না, কাকার চাদর আমি গায়ে দিতে পারি! কত বড় গুরুজন তিনি।
অরণি বিছানায় শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল না।
অনেকদূর থেকে যেন বলল অরণি, তোর শীত করছে না তিথি।
করছে। হঠাৎ কীরকম ঠান্ডা হয়ে গেল সব কিছু।
চাদর গায়ে দিবি?
তিথি পাশ ফিরে হাঁটু ভাঁজ করে শুল।
অরণি মশারির ভেতর থেকেই তার চাদরটা বের করে বলল, ধর। এটা গায়ে দে।
তুমি কী গায়ে দেবে?
বাবার চাদরটা বের করে নিচ্ছি।
তাহলে দাও। তিথি উঠে বসল। তার ফ্রক হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। জঙ্ঘা, ঊরু দেখা যাচ্ছে—সব যেন ফুলের উষ্ণতা নিয়ে ফুটে আছে। তিথির শরীর এত পুষ্ট, এত সাবলীল, এত সুষমা হাতে পায়ে, সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। তবে রক্ষা নিচে আজ অন্তর্বাস আছে। ফ্রকের নিচে শরীর যে উদোম করে রাখেনি। তার সব অস্বস্তি শরীর থেকে সহজেই মুছে গেল।
তিথি চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়ল।
অস্বস্তি থেকে রেহাই পেয়ে হালকা বোধ করল। তিথি চাদরে সারা শরীর ঢেকে নিয়েছে। এমনকি মুখও। মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার এটাই বোধহয় একমাত্র উপায় তিথির।
অরণি যেন কিছুটা নিশ্চিন্তে এবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। কেউ আর কথা বলছে না। তিথি ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
তখনই তিথি বলল, আলোটা নিভিয়ে দিই, চোখে বড় লাগছে।
চোখ কনুইতে ঢেকে শুয়ে আছে অরণি। তিথি যা খুশি করুক, সে কিছু বলবে না। হারিকেন নিভিয়ে দিতে হয় দিক, আলো থাকলে তার ঘুমের যখন ব্যাঘাত হয়—
কি নিভিয়ে দেব?
দে না! আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে, এত কথা আর ভালো লাগছে না।
তিথি হারিকেন নেভালো না। সে শুয়েই আছে। ঘরের কোনায় হারিকেন। বিছানা থেকে উঠে গেলে, মাদুরের ঘস ঘস শব্দ পাওয়া যেত, কারণ সে বুঝেছে তিথি এপাশ—ওপাশ করলেও টের পাওয়া যায়। বৃষ্টি ধরে গেছে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ফোঁটা পড়ছে টিনের চালে। এত নিঝুম হয়ে আছে যে হাই উঠলে, কিংবা জোরে শ্বাস ফেললেও টের পাওয়া যায়।
একটা কথা বলব অরুদা?
বললাম তো, আলো নিভিয়ে দে। আবার কী কথা!
তুমি রাতে ওঠো?
ঠিক নেই।
আমি কিন্তু উঠি।
ভয় পেলে ডাকবি। দরজায় দাঁড়াব।
টর্চটা বালিশের পাশে আছে। দেখে নাও।
কথাই বলছে, আলো নেভাচ্ছে না।
সে চিত হয়ে শুয়ে আছে বলে তিথিকে দেখতে পাচ্ছে না। শিয়রের পাশেই মেঝেতে তিথির বিছানা, হাত বাড়ালে নাগাল পাওয়া যায়, তিথি কী করছে দেখতে হলে তাকে উঠে বসতে হয়। তার মনে পাপ আছে, তিথি যে এত সুন্দর এবং এবার থেকে সে রহস্যময়ী নারী হয়ে যাবে—তার ভেতর পাপ আছে বলেই জেনে ফেলেছে। সেও বড় হয়ে যাবে, তিথির সঙ্গে ঠিক আগের মতো কোনও অকপট কথাবার্তায় জমে যেতে পারবে না। নদীর পাড়ে গেলে, কিংবা চরে নেমে গেলে সে তিথিকে কতদিন সঙ্গে নিয়ে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকারও নেশা তার কম না। নৌকায় উঠে এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে, তিথি সঙ্গে আছে।