অরু অবশ্য বলতে পারত তার মামাবাড়ির দেশে পাকাবাড়ি কেমন হয় সে দেখেছে। তবে সে কিছুই বলল না। দু ক্রোশ রাস্তায় এই সাঁকোটি পার হলেও সড়কে উঠে যাওয়া যাবে। জগদীশ হাতের পুঁটুলি এবং টিনের বাক্সটি নদীর পাড়ে রেখে ঘাটে নেমে গেলেন। অরু তার বাবার পিছু পিছু নামছে। কাঠের গুঁড়ি ফেলে অস্থায়ী ঘাট। গাঁয়ের মানুষজনের ভিড় আছে ঘাটে। জগদীশকে এলাকার লোক সবিশেষ চেনে। ব্রাহ্মণই শুধু নন, তিনি গোস্বামী বংশের সন্তান। তাঁর পিতাঠাকুরকে এলাকার লোক এক ডাকে চেনে। তাঁকে দেখে স্ত্রী—পুরুষ নির্বিশেষে ঘাট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ সবার কুশল নিতে নিতে ঘাটে নেমে যাচ্ছিলেন। পুত্রেরও পরিচয় দিয়ে তারা যে স্টিমার ধরার জন্য রওনা হয়েছেন, রাস্তায় বাবা লোকনাথের আশ্রমে বাল্যভোগ গ্রহণের পর আবার রওনা হবেন, নদীর জলে নামার আগে সেই প্রসঙ্গেই নানা কথা বলছিলেন।
নদীর জল খুবই স্বচ্ছ। জলে স্রোত আছে। নিজে এক গণ্ডূষ জল খেলেন। কারণ রাস্তায় যত্রতত্র আহার এবং জলপান নিষিদ্ধ। তা—ছাড়া পুকুর কিংবা নদীর জলই তৃষ্ণা নিবারণের একমাত্র উপায়। যদিও জগদীশের পিতাঠাকুর তাঁর বাড়িতে একটি ইঁদারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। যে দুটি গ্রামের উপর দিয়ে এলেন, সেখানে একটিমাত্র সরকারি টিউকল—ইউনিয়ন বোর্ড থেকে করা। তবে কলটির হাতল চুরি যাওয়ায় দীর্ঘকাল অব্যবহারে পড়ে থেকে থেকে বাকিটুকুও অদৃশ্য হবার অপেক্ষায় আছে।
জগদীশ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, রাস্তায় আহার এবং জলপানের সমস্যা আছে। পুঁটুলির মধ্যে একটি হলুদ রঙের তরমুজের সাইজ বাঙ্গি আছে। কৌটায় ঝোলা গুড়। স্টিমারে আহারের সুবন্দোবস্ত থাকলেও তাঁর এবং অরুর পক্ষে সেসব স্পর্শ করলে বিধর্মীর কাজ হবে। জাতপাতের বিচার জগদীশের মধ্যে একটু বেশি মাত্রাতেই আছে।
অরণি জগদীশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার যথেষ্ট জল তেষ্টা, অথচ খাওয়া উচিত অনুচিত প্রশ্নে সে গণ্ডূষ করে জল খেতে পারছিল না।
জগদীশেরও জল তেষ্টা পেয়েছে। তিনি গণ্ডূষ করে জল খাবার আগে বলেছিলেন, নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না। পতিত পাবনি গঙ্গারই শাখা—প্রশাখা সব। সবাই সাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তুমি নির্মল চিত্তে জল পান করতে পারো। নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না।
অরু বাবা লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমে বলল, চৈতন্যনাগের বাড়ি পার হয়ে গেলেই কি স্টিমারঘাট?
জগদীশ বললেন, না। চৈতন্যনাগ নদীর ধারেই বাড়ি করেছিলেন, কিন্তু কীর্তিনাশা নদীটি বর্ষায় কখন কোন পাড় ভেঙে ধেয়ে চলবে কেউ জানে না। নদীর পাড়ে বাড়ি করে চৈতন্যনাগ এই এক সমস্যায় ভুগছিলেন। বাবা লোকনাথই অভয় দিয়েছিলেন, আমি যদ্দিন আছি, তোর গৃহনাশের ভয় নেই। নদী যতই উত্তাল হোক, তোর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না।
অরু বাবা লোকনাথের অনেক অলৌকিক কাহিনী শুনেছে। কেমন আশ্চর্য মুগ্ধতা এই সব অলৌকিক বিস্তারের মধ্যে থেকে যায়। বাবা লোকনাথের ব্রহ্মবাক্যে অভিশপ্ত খ্যাপা নদীটি তার উত্তাল তরঙ্গমালা নিয়ে শেষ পর্যন্ত খাত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। নদীটি দেখার ইচ্ছা যেমন প্রবল হতে থাকে তেমনি যে প্রাসাদটি চার পুরুষ ধরে অক্ষত থেকে গেছে, সেটি দেখার বাসনাও তার কম নয়।
লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমেই একটি বড় মাঠ পার হতে হয়। আজ হাটবার নয়। হাটবার মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না। মাঠে গোরু মোষ চরে বেড়াচ্ছে। অঞ্চলে বারদীর হাট বিখ্যাত। নদীর পাড়ে হাটের দিন দু মাল্লা তিন মাল্লা নৌকার ভিড় হয়। যে দিনের যে সবজি, আনারসের নৌকা, তালের নৌকা, হাড়িপাতিলের নৌকা, করলা ঝিঙেও বাদ যায় না—নদীর পাড়ে অজস্র নৌকার ভিড়—দূরদেশ থেকে মানুষজন সওদা করতে আসে নৌকায়—বর্ষাকালে জায়গাটা একটা গঞ্জের মতো হয়ে যায়, পাটের নৌকাও নিয়ে আসে ব্যাপারীরা—তবে অরণি আশ্চর্য হল, লোকনাথের মন্দির সংলগ্ন যে নদীটি আছে, তার বিস্তার তো নেই—ই বরং কিছুটা যেন আবদ্ধ জলার মতো। কচুরিপানায় ঠাসা—হাঁটু জল ভেঙে এ—পাড় ও—পাড় করা যায়। এটা যে মূলনদী থেকে কোনও শাখা বের হয়ে বাবা লোকনাথের চরণ ছুঁয়ে চলে গেছে বুঝতে কষ্ট হয় না। এই জলাদেশটা এতসব নদীনালার ঘোরপ্যাঁচে পড়ে আছে সে তার বাবার কর্মস্থলে না গেলে যেন জানতে পারত না।
অরু এই প্রথম দূরদেশে যাচ্ছে। পাকাবাড়ি কিংবা প্রাসাদ দেখার অভিজ্ঞতা তার নেই বললেই চলে। তবে মামাবাড়ি গেলে চৌধুরীদের পাকাবাড়ি সে দেখেছে। সামনে দিঘি আছে একটা। দিঘির পাড়ে মন্দিরও আছে। মামাবাড়ির দেশটা এজন্য তার কাছে একটি বিশেষ রহস্যময় দেশ। সাদারঙের পাকাবাড়ি, ঘাট বাঁধানো দিঘি, সবুজ ঘাসের মাঠ বাড়ি—সংলগ্ন, সবই তার কাছে অসীম কৌতূহলের বিষয়। মামাবাড়িতে গেলে দিঘির ঘাটলায় বসে থাকলে কেমন সে অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যেত। কেউ এসে তার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে সে কেমন মুহ্যমান হয়ে যেত। ঘরের পর ঘর, ছাদে রঙিন কাচের ঝালর, এবং কিছু তৈলচিত্র, সুন্দর প্রতিমার মতো দেখতে মেয়েরা তাকে আদর করে অন্দরে নিয়ে গেলে সবাই হইচই বাধিয়ে দিত। ও মা দ্যাখো এসে কাকে নিয়ে এসেছি! বাসনাদির ছেলেটা না চুপচাপ আমাদের ঘাটলায় একা বসেছিল!