আর তিথি তখনই একটা ছেঁড়া ছাতা মাথায় পা টিপে টিপে এসে হাজির। তার জল তোলা আছে, হারিকেনে তেল ভরা আছে, চিমনি মুছে তার সাফসোফ করার কাজও আছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। কখন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাও জানে না। মাঠে জল জমে গেছে। জলে কীটপতঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর বিচিত্র শব্দতরঙ্গ উঠে আসছে—কোথাও জল নেমে যাচ্ছে, কোথাও মাটি পাগলের মতো জল শুষে নিচ্ছে— অজস্র বুড়বুড়ি জলে ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখপাখালির ওড়াওড়ি বন্ধ—ডালে বসে বৃষ্টির জলে ভিজছে, কখনও পাখা ঝাপটাচ্ছে। তিথি ঘরে কাজ করছে তার, সে তিথির দিকে তাকাচ্ছে না, সেই পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটাই তাকে বারবার তাড়া করছে।
তিথিকে এখন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলে যেন সারা সকাল—দুপুরের প্রতিশোধ নেওয়া যেত—কিংবা তিথিকে বললে হয়, রাতে আমার ঘরে তোকে শুতে হবে না, রাতে তুই আসবি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই তিথি কখন যে চলে গেল, কোনও কথা বলল না, সন্ধ্যাও হয়ে গেল।
তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কেমন তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। তাকে তাড়াও করছে। সে কখনও বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে, কখনও সেই শরীর এক আশ্চর্য সুবাতাস বহন করে আনছে। সে তিথির এই পড়ে যাওয়ার ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। কত রাত হয়েছে তাও জানে না। গোলঘরে গিয়েও বসেছিল কিছুক্ষণ। ছুটির দিন বলে দ্বিজপদ সার তাদের পড়াতে আসেননি। সে একটা ছাতা মাথায় বাবার টর্চটি নিয়ে পড়ার ঘরে চলে গিয়েছিল, ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ক্যারাম পিটিয়েছে, তারপর রাতের খাওয়া সেরে আবার ঘরে ঢুকে গেছে। তিথি আসেনি।
তিথি এলে কী হবে?
সে দরজা বন্ধ করে দিল।
দূরে শেয়ালেরা ডাকছে। এই বিভীষিকাকে সে গ্রাহ্য করতে চায় না।
তিথি একফাঁকে তার বিছানা করে রেখে গেছে। মশারিও টাঙানো। চকির অন্যপাশে বাবার বিছানা গোটানো। তিথি এসে শোবে কোথায়!
তিথি তার আলাদা বিছানাও পেতে রাখেনি। তিথির সঙ্গে তার একটাও কথা হয়নি আর। সে এই ঘরে শুতে নাও আসতে পারে।
কিছুটা হালকা হয়ে গেল। জানালা খোলা আছে—ঝিরঝিরে বৃষ্টির ক্লান্তি নেই—বর্ষা শুরু হয়ে গেল বোধহয়। জোনাকি জ্বলছে ঝোপে জঙ্গলে—কেমন নিথর হয়ে আছে চরাচর। সে শুয়ে পড়ল।
তিথির কথা ভাবতে ভাবতেই সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। তখনই দরজায় টোকা। খুবই সন্তর্পণে।
সে সাড়া দিল না।
তারপর কড়া নাড়ার শব্দ।
সে পাশ ফিরে শুল।
এই অরুদা দরজা খোল। কী হল রে বাবা! কুম্ভকর্ণের নিদ্রা!
সে নাক ডাকাতে থাকল।
দ্যাখ অরুদা সারাটা দিন, অনেক জ্বালিয়েছ, কিছু বলিনি। মটকা মেরে পড়ে আছো, তুমি মনে করো আমি কিছু বুঝি না। কাকা বারবার বলে গেছে, না হলে তোমার ঘরে শুতে আমার ভারী বয়ে গেছে।
সে যেন সাহস পেয়ে গেল এবার। সে বলল, একা শুতে আমার অসুবিধা হবে না। তুই যা। এত রাতে আর জ্বালাবি না।
জ্বালাব না! কে জ্বালায়? আমি না তুমি! দরজা খোলো বলছি। খোলো বলছি।
তিথি দরজা ধাক্কাতে থাকল।
তিথি চেঁচামেচিও শুরু করে দিতে পারে। এত রাত্রে চিৎকার—চেঁচামেচি কেউ শুনতে পেলে কী ভাববে! অবশ্য ঘরটা মাঠের মধ্যে—জমিদারবাবুদের প্রাসাদও কাছে নয়, যে শোনা যাবেই, তবু যদি কেউ শুনেই ফেলে—সে তাড়াতাড়ি মশারি তুলে চকি থেকে নেমে গেল—হারিকেন উসকে দিল। দরজা খুলে অবাক, কোনওরকমে তালিমারা ছাতায় তিথি তার মাদুর বালিশ বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচিয়ে সিঁড়িতে উঠে এসেছে।
নাও ধরো। বলে বগলের মাদুর বালিশ তাকে দিয়ে ছাতাটা বন্ধ করার আগে বলল, এক ঘটি জল দাও। পায়ে কাদা লেগে আছে।
তিথি যা বলছে, অরু বাধ্য ছেলের মতো সব করে যাচ্ছে। তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে—তার মাথাটা ফের কেমন গোলমালে পড়ে গেল।
সেই এলি!
আসব না কেন?
সে আর কিছু বলল না।
তিথি মেঝেতে মাদুর পেতে তারপর বালিশ ঠেলে দিল ওপরের দিকে। সে আলগা হয়ে মাদুরে বসেছে। গামছা দিয়ে পা মুছল।
তিথি আজ আলতা পরেছে পায়ে।
তিথি তার বোধহয় পুজোর ফ্রক গায়ে দিয়েছে। সুন্দর লতাপাতা আঁকা ফ্রকে তিথির স্তন কিছুটা ভেসে উঠেছে। এই প্রথম তিথিকে সে চুরি করে দেখছে। তিথির দিকে তার এতদিন যেন কোনও নজরই ছিল না। এমনকি নদীর জলে তিথিকে সামান্য তিথি বলেই এত ঝগড়া করতে পেরেছে। তিথি যেন সহসা হাওয়ায় বড় হয়ে গেল তার কাছে—ফ্রকটা যে কিছুটা টাইট তাও বুঝতে পারল। সে যে ঢোলা সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ফ্রক পরে থাকে—তার কোনও অন্তর্বাস থাকে না, সে চিত হয়ে পড়ে না গেলে কিছুই টের পেত না। পড়ে গিয়েই তাকে এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, এই মুহূর্তে তিথিকে দেখে তাও বোঝা গেল।
তিথি মুখে প্রসাধনও করেছে। তুলির কাছ থেকে ইচ্ছে করলে সবই চেয়ে নিতে পারে। চুল দু’বিনুনি করে মাথায় টেনে বেঁধেছে। হাতে পিতলের চুড়ি পরেছে। নাকে নথও ঝিলমিল করে উঠল। কিন্তু তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে!
তিথি এবার তাকাল। কী হল, বসে থাকলে কেন, শুয়ে পড়ো।
তোর মশারি আনলি না? মশারি টাঙিয়ে না শুলে মশা কামড়াবে।
অতীব এক তির্যক চোখে তার দিকে তাকিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মশা আমাকে কামড়ায় না।
মশা তোকে কামড়ায় না?