তিথি সরল বিশ্বাসে বলেছিল, স্বপ্নের কথা লেখা থাকে। ও চিঠি পড়তে হয় না। পড়লে পাথর হয়ে যেতে হয়।
তিথিও কি কোনও স্বপ্নের চিঠি নিয়ে ছুটছে! সে কাছে থাকলে জোরজার করে পড়ে ফেলতে পারে ভয়েই কি ছুটছে! পড়লে সে পাথর হয়ে যেতে পারে—সে পাথর না হয়ে যায়, কারণ সে যে তার সবকিছু দেখে ফেলেছে। অরুদা পাথর হয়ে গেলে সে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে!
অরণি বুঝতে পারে নদীর চরায় তিথি ক্রমে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। সব আজগুবি চিন্তায় সে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না।
তিথি শেষে কিছু করে বসবে না তো!
এখুনি বাড়িতে গিয়ে খবর না দিলেই নয়।
কারণ নদীর পাড়ে তিথি অদৃশ্য হয়ে গেছে, সেখানে কি কোনও অরণ্য আছে, অথবা কোনও স্পৃহা থেকে, এমনকি তাকে লোভে ফেলে দেওয়ার জন্যও যে ছুটছিল না তারই বা ঠিক কি!
কিছুক্ষণ সে তরমুজের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকল।
চাষি মানুষটি পাতার আড়াল থেকে উঠে বলল, আপনি বাড়ি যান বাবু। তিথির জন্য ভাববেন না। ও এরকমেরই। চাষি মানুষটি তো জানে না, আজ নদীর পাড়ে বড় অঘটন ঘটে গেছে তাদের। তিথি তার মুখ কাউকে আর বোধহয় দেখাতে চায় না।
সে বড়ই অস্থির হয়ে উঠছে।
তার পা চলছে না। একবার একটা গাছের গুঁড়িতে ধপাস করে বসেও পড়ল।
তিথি নেই, উত্তপ্ত বালির চড়া ডিঙিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তিথি।
কেন গেল?
কী হয়েছিল!
তখন সে কী বলবে?
তাকে মিছে কথা বলতে হবে।
এই করে সে যখন কাছারিবাড়ি পৌঁছাল—সবাই ছুটে এসেছে।
এই তুই কোথায় গেছিলি! কত বেলা হয়েছে, খাবি না! রান্নাবাড়িতে মা বারবার খোঁজ নিচ্ছে, তুই কোথায়! সে তো খেতে এল না!
তার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। রোদে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। চুল উসকোখুসকো। চোখ জবাফুলের মতো লাল। তিথি যে কোথায় চলে গেল, প্রায় কেঁদেই ফেলত—আর তখনই তিথি সুন্দর একটি ফ্রক গায়ে তুলির সঙ্গে হাজির। তুলির কাছ থেকে পাউডার চেয়ে নিয়ে মুখে পর্যন্ত মেখেছে।
তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল যেন।
তিথির সঙ্গে একটা কথাও বলল না। তুলি তাকে দেখে মুচকি হাসছে। এতে তার রাগ আরও বেড়ে গেল। দৌড়ে সে কাছারিবাড়ির ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে জামাপ্যান্ট ছেড়ে রাখল। তারপর কাচা হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায়ে দিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সে খায়নি বলে বাবার বউঠান এখনও না খেয়ে আছে।
এই বাড়ির আলাদা যে রুচিবোধ আছে, ভেতরবাড়ি গিয়েই সে টের পেল। সে শুধু খায়নি, আর সবাই খেয়ে নিয়েছে এ বাড়িতে বোধহয় তা হয় না। আসন পাতা আছে পর পর। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। কাগজিলেবু, নুন, কাচালংকা সাজানো—সে ভেতরবাড়ি ঢুকতেই সোনাদা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, বাবু এয়েছেন মা। রোদে কোথায় টো—টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভুঁইঞাকাকা নেই, তিনিও স্বাধীন। আসুক ভুঁইঞাকাকা, কোথায় যাস!
বাবার বউঠানকে সে জেঠিমা ডাকে। সামান্য স্থূলকায় এবং ফর্সা দেখতে, হাতে চকচক করছে সোনার বালা, পায়ে আলতা, তাঁর বউমাটিও হেঁশেলে অপেক্ষা করছেন, তার জন্য সবারই পাতে বসতে দেরি হয়ে গেল, তিথি কতভাবে যে ভোগাচ্ছে!
জেঠিমা বললেন, কীরে তোর চোখমুখ এত শুকনো কেন! তোর বাবা কাজে বাইরে গেছেন বলে, যেখানে—সেখানে ঘুরে বেড়াবি! কী চিন্তা হচ্ছিল!
তারপর বললেন, বলে যাবি তো! কেউ কিছু বলতে পারল না। তিথিও না।
পা থেকে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিথি এত বেইমান! সারাটা সকাল—দুপুর তাকে ঘুরিয়ে হয়রান করেছেন, সে বলেছে, কিছু জানে না!
তিথির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সেই আগের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে রোয়াকে। সেই যে আসন পেতে দিয়েছে, গেলাসে গেলাসে জল ঢেলেছে, এবং থালায় কাগজিলেবু, কাঁচালংকা সাজিয়ে রেখেছে, বসে পড়লেই সবার পাতে পাতে সব সে দেবে—অথচ ঘুণাক্ষরেও জানাল না, সে চরে তরমুজের জমিতে তার জন্য কতক্ষণ যে অপেক্ষা করেছে! নিজে কোথা থেকে কীভাবে যে ঠিক উঠে এসেছে, সে কি একবারও দেখতে পায়নি, কেউ তার জন্য নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে! এত শয়তান মেয়েটা! সে তো রাস্তাঘাট ভালো জানে না। বাবা তাঁর কর্মস্থলে নিয়ে এসেছেন। স্কুলে সেই কবে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে একা নদীর পাড় ধরে বেশিদূর হেঁটেও যায় না। ভয়, সে না কোথাও হারিয়ে যায়। নদীর ওদিকটায় সে কখনও যায়ওনি। সে জানবে কী করে, আসলে তিথি দৌড়ে একা উঠে আসার জন্যই তাকে নদীর চরে ফেলে রেখে এসেছে।
গরমে চরাচর যেন হাঁসফাঁস করছে। খাওয়া হয়ে গেলে সে কোনওরকমে মাঠ পার হয়ে শেকল খুলে ঘরে ঢুকে গেল। চকির কাঠ পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে আছে। রোদে এত তেজ যে বাইরে তাকানো যাচ্ছে না। কাকগুলির কর্কশ চিৎকারে কেমন তার মাথা ধরে যাচ্ছে। জানালা খুলে দিয়ে ভেবেছিল, নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসবে। তাও এল না। গরম বাতাসে মুখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। এই ঘরে শুয়ে থাকার অর্থ ভাপে সেদ্ধ হওয়া। কোনও গাছতলায় গিয়ে বসে থাকলেও বোধহয় আরাম পাওয়া যেত। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছে না। জামা খুলে বালিশ টেনে শুয়ে পড়তে গিয়ে টের পেল, বালিশ চাদর তোশক সবই তেতে আছে। তার যেন আর নড়ারও ক্ষমতা নেই। সে শুয়ে পড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
টিনের ঘর বড় সহজেই গরম হয়ে যায়, আবার ঠান্ডাও হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যেই সে টের পেল, তিরতির করে চোরা ঠান্ডা স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মেঘ গর্জনও শুনতে পেল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে কখন, জানালা দিয়ে ছাঁট আসছে, সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। জানালা দিয়ে দেখল, গাছের শাখা—প্রশাখা দুলছে। বেশ জারে হাওয়া দিচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির জলতরঙ্গ আওয়াজ। কখনও ঝমঝম, কখনও রিনরিন। প্রকৃতির চেহারাই পালটে গেছে। তার শীত শীত করছিল। বিছানার চাদর গায়ে জানালার ধারে অঝোরে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখার জন্য সে কেমন পাগল হয়ে উঠল। দুরন্ত তিথি তাকে কিছুতেই ছাড়ছে না—কিংবা তুলি। বারবার তাদের চোখ মুখ শরীরের তাজা গন্ধ বৃষ্টির ছাটে মিলেমিশে গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে।