লাগুক। একশোবার লাগবে। তুমি আমার সঙ্গে কখনও আর কথা বলবে না।
ঠিক আছে, বলব না। চল এবার।
আমি তোমাকে মজা দেখাচ্ছি, দাঁড়াও।
এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেল অরণি। তিথি কি তুলিকে সব বলে দেবে! মেয়েদের কত গোপন কথা থাকে। তুলির সঙ্গে যে এত ভাব, সেই গোপন কথার সুবাদে। সে বাবুদের বাড়িতে থাকে। বাবা তার বাবুদের আমলা। বাবুদের মেয়ে তুলির হাতে এভাবে অস্ত্র তুলে দিলে সে যে খুবই বিপদে পড়ে যাবে। এখন তিথিকে বশে না আনতে পারলে সত্যি কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেই সবুজ নিঃসঙ্গ প্রান্তরটি কিছুতেই চোখ থেকে তার সরছে না। তিথির সব মাহাত্ম্য সবুজ প্রান্তরে সে গোপন করে রেখেছিল। তাই যদি কেউ দেখে ফেলে তবে আর তিথির ইজ্জত থাকে কী করে!
সে ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল।
গরমের তাপে তার জামাপ্যান্ট শুকিয়ে যাচ্ছে। তার হাফপ্যান্টের নিচে কাদা লেগে আছে। হাতে—পায়ে কাদা। তিথি তাকে কাদায় মাখামাখি করে দিয়েছে আঁচড়ে খামচে দেওয়ার সময়।
সে সোজা জলে নেমে আবার ডুব দিল—নদীর জল এত ঠান্ডা হয়ে আছে নিচে যে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তিথির সামনে তার দাঁড়াবার আর সাহস নেই। সে জল থেকে উঠে সোজা দৌড়াতে থাকল। যা হয় হবে। কিন্তু তিথি রাতে আসবে। তখন যদি সে কিছু করে বসে। তার তো আর ইজ্জত ধর্ম কিছু নেই। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাঁটা খেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে তিথি, তারও যে এত ইজ্জতবোধ জানবে কী করে!
সে কিছু করেই বসতে পারে।
কিছুটা এসেই মনে হল এভাবে তিথিকে একা ফেলে চলে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। নদীর চর এখন সামনে পেছনে। নদীর পাড় ধরে ইতস্তত দু—একজন চাষী কিংবা ব্যাপারী মানুষ বাজারের দিকে যাচ্ছে। কোথাও আজ হয়তো হাটবার আছে, চরের পাশে কিছু নৌকায় আনাজ তরকারি উঠছে। কেউ নেমে যাওয়ার সময় বলল, অরুবাবু যে! এত রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন দেখছি। মুখ রোদে পুড়ে গেছে। ভুঁইঞামশায় কবে ফিরবেন!
সে বলল, জানি না।
সে মরছে তার আতান্তরে।
কারণ আরও দূরে সেই মেয়েটি কী করছে, দেখারই বেশি বাসনা তার।
তিথি জলে নেমে গেল, ডুবও দিল, তারপর পাড়ে উঠে দৌড়াতে থাকল তার পিছু পিছু।
যাক, মাথা ঠান্ডা হয়েছে।
সে দাঁড়িয়ে গেল।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
বোধহয় তিথি তার সঙ্গে ফিরতে চায় না।
সে আবার দাঁড়াল। তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কি তাকে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়! এতবড় অঘটনের পরে তিথিরও দোষ দেওয়া যায় না। মাথা ঠান্ডা হওয়ায় তার লজ্জায় পড়ে গেছে।
সে আবার হাঁটতে থাকল।
তিথিকে সঙ্গে না নিয়ে ফিরলে, আবার কোথায় কী করে বসবে, তিথিও তাকে যথেষ্ট নির্যাতন করেছে, তিথির মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ছিল, এখন মাথা ঠান্ডা হওয়ায় সে নানা ফন্দিও আঁটতে পারে। সে তো তাকে ডাকেনি। ওই যে দোষ তিথির, সব সময় নজর রাখা, কখন সে ঠিক দেখেছে অরুদা নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বড় বড় সব কড়ুই গাছের নিচ দিয়ে অরুদা তার বাবার পিছু পিছু ঘাটের দিকে যাচ্ছে। তিথি এইসব ভেবেই সুপারিবাগান থেকে বের হয়ে পড়েছিল বোধহয়। তারপর তাকে জলে নেমে যেতে দেখে লোভ আর সামলাতে পারেনি।
কিন্তু তিথির পরনে ইজের ছিল না। তিথির বাবা খুবই গরিব। দস্যি মেয়ের প্যান্ট কিনে দিলেও দু—এক মাসে সেলাই খুলে যায় বোধহয়, ফেঁসেও যেতে পারে। তিথি সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ঢোলা জামা গায়ে দিয়ে থাকে—ঝুল আছে অনেকটা, হাঁটুর অনেক নিচে সেমিজ ঝুলে থাকে—তার কি ইজের পরার অভ্যাস নেই! কারণ তার শরীর ঢাকাই থাকে। ইজের না পরলেও চলে যায়, গরিব হওয়ার জন্য তিথি এমন ভাবতেই পারে। বাপের কাছে বারবার ইজের চাইতেও তার সম্ভবত লজ্জাবোধ হয়। সে তো কিছু চাইতেই জানে না। দয়া করে যে যা দেয় তাতেই খুশি মেয়েটা।
তাহলে তিথি তার ঘরে আসে ইজের না পরেই। সে জল তুলে রাখে, ঘরদোর ঝাঁট দেয় ইজের না পরেই। তার কাছে এটা বোধহয় বেআব্রু মনেই হয় না। এত গরিব হলে চলে!
এবং এসব মনে হতেই তিথির জন্য কেমন এক কান্না ভেতরে গোল গোল দলা পাকিয়ে গলার কাছে থমকে গেল।
সে আবার দাঁড়াল। এখান থেকে দূরের প্রাসাদ সব দেখা যায়। কার্নিসের মাথায় পরী উড়ছে। উঁচু লোহার রেলিং দিয়ে বাগান মাঠ এবং পুকুর সব ঘেরা। বৈভব এত চারপাশে, আর তিথি একটা ইজেরের কার্পণ্য করে গরিব বাপের টাকা বাঁচায়।
অরণি আবার পেছন ফিরে তাকাল।
তার কেন যে মনে হল এই অভাগা মেয়েটাকে ফেলে চলে যাওয়া কোনও কারণেই উচিত হবে না।
কিন্তু যা হয়।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেছে।
সে আর পারল না। তিথিকে ধরার জন্য এবার সে নিজেই দৌড়াতে লাগল।
বৈশাখের খরতপ্ত বালিরাশিতে দু’জনেই নেমে গেল। কিন্তু তিথির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তিথি যে কত বন্য হয়ে উঠতে পারে চরের এই বালিরাশি মাড়িয়ে না গেলে টের পেত না। তার পায়ে ছ্যাঁকা লাগছে। কিছুটা গিয়েই সে আর এগোতে সাহস পেল না। তরমুজের জমিতে উঠে তরমুজের লতাপাতার ওপর দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কিন্তু দৌড়ে চলে যাচ্ছে।
সে খুবই অসহায় বোধ করতে থাকল।
তিথি কোথায় যাচ্ছে! কাকে ডাকবে! কাছারিবাড়ি উঠে গিয়ে কমলদা কিংবা বিশুদাকে খবর দিতে পারে। সে আর তাদের নাম ধরে ডাকে না। কমল অমল বিশুরা তার কাছে সোনাদা, সেজদা, ছোড়দা হয়ে গেছে। সোনাদাকে তিথি ভয় পায়। একদিন কী কারণে সোনাদা তিথির কানও মলে দিয়েছিল। তিথি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে, কিন্তু সোনাদা কানও মলে দিয়েছে বলে কাউকে নালিশ করেনি। তিথিও তার কাজের জন্য বাবুর বাড়ির সবার কাছে প্রিয়। শুধু প্রিয় না, বিশ্বস্তও। ছোটপিসির চিরকুট সে হরিশবাবুকে গোপনে পৌঁছে দেয়। শুধু সেই খবরটা রাখে। তিথি কখনও চিরকুটটি তার হাতে দেয়নি, পড়তেও দেয়নি। ছোটপিসি বালবিধবা। তার যে কত কষ্ট তিথিই বোধহয় একমাত্র টের পেয়েছে। তবু একদিন তিথিকে না বলে পারেনি, চিরকুটে কী লেখা থাকে জানিস?