সে তিথিকে অনায়াসে তেড়ে যেতে পারত। তিথি যতই ভালো সাঁতার জানুক, সে ইচ্ছা করলে তিথিকে গিয়ে অনায়াসে ধরে ফেলতে পারে। ডুবসাঁতারে চিতসাঁতারে সেও কম দক্ষ নয়, কিন্তু তার ইচ্ছেই করছে না তিথির দিকে তাকাতে। বাবা তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে না বললেই পারতেন। তারা যে বড় হয়ে গেছে বাবা কিছুতেই বোঝেন না।
সে যে তিথির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ।
তিথি অন্তত বুঝুক কাছারিবাড়িতে তার রাতে থাকা সে পছন্দ করছে না। তিথিটা বোকা না পাগল তাও সে বোঝে না। তাছাড়া সেও কম অসহায় নয়, তিথিকে সে বারণ করে দিতে পারে, বেরও করে দিতে পারে ঘর থেকে, কিন্তু নিঝুম রাতে পাখিরা কলরব করলে, কিংবা কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠতে পারে, হাওয়ায় টিনের চালে ডালপালার ঘর্ষণের বিদঘুটে আওয়াজ, একা ঘরে শুয়ে খুবই উপদ্রবের শামিল সে বোঝে। আর রাতে ঝড়বৃষ্টি হলে সে যে খুবই ফাঁপরে পড়ে যাবে। শুয়ে থাকলে, কড়িবরগায় ফেলে রাখা মুলিবাঁশের ছাদে ধস্তাধস্তি যদি শুরু হয়, রাতে অশুভ আত্মারাও তাকে একা পেয়ে নানা তামাশায় মত্ত হতে পারে—এইসব চিন্তাতেই তিথিকে সে ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছে না। তিথি ইচ্ছে করলে রাজি নাও হতে পারত, বাবা তবে আর কারওকে বলে যেতেন। কিন্তু তিথি যে এক পায়ে খাড়া। বাবাও বোঝেন না, তিথিও তুলির মতো বড় হয়ে গেছে। এবং তার ভেতর নিজের শরীর নিয়ে এক গোপন অভিমান গড়ে উঠছে—তার মূর্ছা যাওয়ার কথাও একরকম যেন জোর করেই চাপানো—এতে আর কারও সুবিধা না হোক, তিথির খুবই সুবিধা হয়েছে। যেন সে নিজের অধিকারেই তাকে পাহারা দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেছে।
সে তিথিকে কিছু বলছে না।
তার দিকে জলের ঢেউ তুলে দিচ্ছে তিথি।
তাকে ডাকছে, অরুদা চলো সামনে যাই। তুমি কতটা দূরে যেতে পারো দেখি। চলো নদী পার হয়ে ওপাড়ে উঠি।
সে তীরের দিকে উঠে যাচ্ছে। তিথির কথায় সাড়া দিচ্ছে না।
তিথি তার পিছু নিয়েছে।
এই অরুদা উঠে যাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে কিছু বলেছি?
অরণি ভ্রূক্ষেপ করছে না। তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে।
এই অরুদা ঠিক আছে, আর জল ছিটাব না। তুমি ডুবে মাটি তুলতে পারবে? আমি পারি,দেখবে?
অরণি ঘাটের কাছে, যেখানে কাদামাটি এবং খুবই পিছল, পা টিপে টিপে এগোচ্ছে।
তিথি মানবে কেন?
সে লাফিয়ে জল থেকে উঠে অরণির কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরল। তিথি তাকে জলে নিয়ে নামবেই। তিথি তাকে জল থেকে উঠতে দেবে না। সে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জোরাজুরি করলে তিথি জলে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে যেতে পারে। না করেও উপায় নেই, সে এক ধাক্কায় তিথিকে সরিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখল তিথি পড়ে গেছে চিত হয়ে। পড়ে গিয়ে সড়াৎ করে নদীর ঢালুতে পিছলে গেছে।
তিথির ফ্রক কোমরের উপরে উঠে যাওয়ায় সে পুরোদস্তুর বেকুব। তিথি ইজের পরেনি। শুধু ফ্রক গায়ে জলে নেমে এসেছে। সে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছি! সে এটা কী করল! খুবই অপরাধ তার। তিথির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সে অযোগ্য। সে জানবে কী করে তিথি ইজের না পরেই জলে নেমে এসেছে। তার শরীর রোমাঞ্চিত, আবার অপরাধবোধও আছে, সে তিথির দিকে আর তাকাতে পারছে না। ভাগ্যিস ঘাটে কিংবা নদীর পাড়ে কাছাকাছি কেউ নেই!
তিথির দিকে সে ফিরে তাকাতেও পারছে না।
তিথি এখন কী করছে তাও সে জানে না।
তিথি যদি দেবী দুর্গার মতো জলের কিনারে একইভাবে পড়ে থাকে, তবে আর যাই হোক, তাকানো যায় না। সে নিদারুণ সঙ্কটে পড়ে গেল। কাছে যেতেও পারছে না। হাত ধরে তুলে দিয়ে বলতে পারছে না, ওঠ তিথি। তোর লাগেনি তো!
তিথি কোনওরকমে ততক্ষণে উঠে বসেছে। ফ্রক দিয়ে হাঁটু, শরীর সব দ্রুত ঢেকে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে!
সে খুবই কাতর গলায় বলল, ওঠ। আর ফেলব না। আমি কি জানি তুই পড়ে যাবি! ধাক্কা দেব কেন!
তিথি ছাড়ার পাত্র নয়। সে বলল, আমার সব তুমি দেখে ফেললে কেন? বলো কেন দেখে ফেললে!
না, আমি তোর কিছু দেখিনি বলতে পারত। কিন্তু বড় মিছে কথা হবে। সে সবই দেখেছে, এমনকি সবুজ নিথর প্রান্তরটিও। এত কুহক, এই শরীরে, সে চোখ ফেরাতে পারছে না, নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রকৃতি আর শরীরের এক অসীম অনন্ত লীলারহস্যের যুগপৎ খেলায় সে অস্থির হয়ে উঠছে। প্রকৃতি তার বাহু মেলে দিয়েছে তিথির শরীরে।
তিথির কাছে এখন যাওয়া যায়। তিথি সব ঢেকে হাঁটুর কাছে ফ্রক টেনে কাদার মধ্যেই লেপটে বসে আছে। সে উঠছে না।
অরণি হাত ধরে না ওঠালে, সে যেন উঠবে না।
সে কাছে গিয়ে বলল, ওঠ। বাড়ি যাব।
তিথির চোখে জল। তিথি কোনও জবাব দিচ্ছে না।
অরণি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
তিথির সবকিছু সে দেখে ফেলে কেমন কিছুটা মুহ্যমান। সে কাছেও যেতে সাহস পাচ্ছে না। তিথির রোষ শেষ পর্যন্ত কীভাবে ফুটে বের হবে, সেই আতঙ্কেই সে অস্থির।
তিথি ওঠ। আমি কী জানি তুই পড়ে যাবি। আমার কী দোষ বল? তুই কাঁদছিস কেন তাও বুঝছি না। আমি ইচ্ছে করেও তোকে ফেলে দিইনি!
তিথি সহসা লাফিয়ে তার জামা খামচে ধরল। আঁচড়ে খামচে দিচ্ছে।
কেন তুমি আমার সব দেখে ফেললে! আমার আর কী থাকল!
অরণি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই আমার লাগছে তিথি। তুই কী করছিস বল তো।