কী যে বিপদ—সে বলল, হরমোহনদাদু থাকলে হয় না!
সেও তো আমার সঙ্গে যাচ্ছে। তিথি শুলে কি তোমার আপত্তির কিছু আছে!
আপত্তির কথা বলার অর্থই সে সব বুঝতে শিখে গেছে। এই বুঝতে পারাটা এই বয়সে কত বড় অপরাধ গুরুজনদের কাছে সে বোঝে।
সে বলল, না না আপত্তির কী আছে? তবে কেউ না শুলেও আমার অসুবিধা হবে না। আমার জন্য আবার তিথিকে বিরক্ত করা…
সে বিরক্ত হয় না। তার এই সুন্দর স্বভাবের জন্যই সে জীবনে সুখী হবে। একবার তার কাজকাম বন্ধ করে দিয়ে তো বুঝেছিলে, কী অনর্থ ঘটতে পারে!
বাবা সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলেন। হরমোহনদাদু মাথায় ফেট্টি বেঁধে পেছনে রওনা হল। কাঁধে লম্বা বেতের লাঠি। মাথায় একটা পুঁটুলি। বাবা ক্যাম্বিসের জুতো পরে হাঁটুর সামান্য নিচে কোঁচা লুটিয়ে দুগগা দুগগা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। সিঁড়ি ধরে নামার সময় বলেছিলেন রোদে ঘুরে বেড়াবে না, নদীতে চান করতে গেলে দু ডুব দিয়ে উঠে আসবে। জলে পড়ে থাকবে না। এ সময়টা দেবী ওলাওঠার আবির্ভাব হয়, নদীর জল না খাওয়াই ভালো। গুটি বসন্তের কাল, রোদের তেজ প্রখর, ঝোড়ো হাওয়ায় বেশি ঘুরে বেড়াবে না। হাওয়ার সঙ্গে গুটি বসন্তের জীবাণু উড়ে বেড়ায়।
তারপর বাবা বলেছিলেন, ঋতুটির রঙ বড়ই অগ্নিবর্ণ। ওলাওঠায় চরের মানুষজন সাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষেধকের কোনও ব্যবস্থা নেই। চৌকির নিচে নিমের ডাল রেখে দেবে রোজ। এতে কিছুটা প্রতিষেধকের কাজ করবে।
এটা ঠিক, এই ঋতুটির আবির্ভাবের সঙ্গে বাবা রোজ কিছু নিমপাতা বালিশের নিচে রেখে দেন। কখনও নিমের ডাল এনে চকির নিচে ঢুকিয়ে রাখেন। রান্নাবাড়িতে কচি নিমবেগুনের ব্যবস্থা হয়। টিউকল কিংবা ইঁদারার জল ছাড়া পানীয় জলের ব্যবহার থাকে না। নদীর জল কিংবা পুকুরের জল যে খাওয়া হয় না তাও নয়। তবে ফুটিয়ে। তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তার যে শেষ থাকে না, এইসব বাধা নিষেধে সে ভালোই টের পায়। চরে কিংবা নদীর পাড়ে ছুটতে ছুটতে তেষ্টা পেলে নদী থেকে গণ্ডূষ করে সে কেন, সবাই জল তুলে খায়। বর্ষায় কিংবা শীতে খাওয়া গেলেও এ—সময়টায় খাওয়া একেবারেই অনুচিত, বের হওয়ার আগে পই পই করে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন।
বাবা বের হয়ে গেলে সেও কিছুটা হেঁটে গেল। নদীর পাড় পর্যন্ত সে গেল। নদীতে নৌকা লেগে আছে। চরের ওপর দিয়ে অনেকটা রাস্তা হেঁটে গিয়ে বাবা নৌকায় উঠে পড়লেন। কালীগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর আর নৌকা যাবে না। বর্ষা না নামলে নদী নাব্য হয়ে উঠবে না।
যতক্ষণ বাবার ছই দেওয়া নৌকাটি দেখা যাচ্ছিল, অরণি পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এত নিরিবিলি এই ঘাট যে কাকপক্ষী উড়ে গেলেও ডানার শব্দ পাওয়া যায়। আজ ছুটির দিন বলেই সে বেশি একা। স্কুলে গেলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় এবং বিকেলে তারা সবাই মিলে হইহই করতে করতে স্কুল থেকে একসঙ্গে ফেরে। গাছে ফলপাকুড়েরও অভাব থাকে না। লটকন ফলের গুচ্ছ সহজেই লাফিয়ে গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া যায় কিংবা মজাখালের পাড় ধরে ফিরলে কার্তিক অঘ্রাণে সহজেই বেতঝোপে বেথুনফলের খোঁজে ঢুকে যাওয়া যায়। ছুটির দিনটি এমনিতেই তার কাটতে চায় না, আজ বাবা না থাকায় কেমন বিমর্ষ লাগছে—কিছুটা নিরুপায় যেন সে! আর তখনই কোনও জঙ্গলে বসে তিথি ‘কু’ দিচ্ছে।
তিথি না অন্য কেউ! তবে কেন যে মনে হল তিথি ছাড়া তার সঙ্গে মজা করার সাহস কারও নেই। ডানদিকের সড়ক পার হয়ে গেলে জেলে পাড়া, তার বয়সি ছেলেছোকরার অভাব নেই। তার বয়সি মেয়েও অনেক। তবে ভুঁইঞামশায়ের পুত্র বলেই তাকে যথেষ্ট সমীহ করে। কেউ কেউ তার সঙ্গে আপনি—আজ্ঞে করে— সুতরাং চরের কাশবন থেকে যেই তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করুক, সে পাত্তা দেবে না। তার মন ভালো নেই। কাছারিবাড়িতে ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। গরমও পড়েছে। বেলাও বিশেষ হয়নি, অথচ মনে হচ্ছে হাওয়ায় আগুনের ভাপ ছড়াচ্ছে। নদীর জলে ডুবে থাকলে এ সময় বেশ আরাম পাওয়া যায়।
সে নদীর চর ধরে দৌড়ে যেতে থাকল।
তখনই মনে হল ঝুপ করে কেউ জঙ্গলে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে ফিরেও তাকাল না। কারণ তিথি যদি সত্যি হয়, তবে এই পেছনে লেগে থাকা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে।
সে জলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নদীর জলে সকাল সকাল মানুষের ভিড় থাকলেও বেলা বাড়লে ভিড় কমে যায়। প্রায় লু বইবার মতো অবস্থা। নদীর ওপারের ঘাটে কেউ কাঠ কাটছে, নদীতে এদিক—ওদিক নৌকা পড়ে আছে ঠিক, তবে মাঝিমাল্লাদের দেখা যাচ্ছে না। কাঠ কাটার শব্দ নদীর পাড়ে বড় বেশি আওয়াজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জলে ডুব দিয়েও সেই আওয়াজ শোনার সময় মনে হল তার পা কিছুতে জড়িয়ে ধরেছে।
জল এদিকটায় এখন গভীর। সে ভোঁস করে ভেসে উঠল। তীর থেকে বেশ দূরেই সে চলে এসেছে। ঘাট থেকে মানুষজন ডুব দিয়ে উঠে যাচ্ছে, তার পায়ে কে যে জড়াজড়ি করে সরে গেল, সে ভোঁস করে ভেসে উঠেও কিছু দেখতে পেল না। তারপরই মনে হল পাশেই কেউ আছে—তার দিকে জল ছিটাচ্ছে। তিথি ছাড়া আর কারও যে সাহস হবে না তাও সে জানে।
সে দেখবে না। তিথি যাকে সে এড়িয়ে চলতে চায়, সেই তাকে নিষ্কৃতি দিচ্ছে না।
সে যে কত অসহায়, বাবা যেন তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে বলে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। মেয়েটার উপদ্রবে শেষে সে কি অস্থির হয়ে উঠবে!