অরু খেপে গিয়ে বলল, আমার কপালে না তোর কপালে!
বারে, আমার কী দোষ!
হরিশবাবুকে ছোটপিসির চিরকুট গোপনে পাচার করিস, ওটা বুঝি দোষ না।
তুমি অরুদা নিষ্ঠুর। জানো, ছোটপিসি বালবিধবা?
জানব না কেন? তাই বলে তোকে দিয়ে চিঠি পাচার করাবে! জানতে পারলে তোর কী হবে জানিস?
কী হবে?
অন্দর থেকে তোকে বাবুরা তাড়াবে।
জানবেই না, জানতে দেবই না। তুমি ছাড়া আর কেউ যে জানে না।
চিঠিতে কী লেখা থাকে জানিস?
হ্যাঁ, জানি।
বড় অকপটে তিথি স্বীকার করে ফেলল।
কী লেখা থাকে বল তো!
স্বপ্নের কথা লেখা থাকে। জানো স্বপ্নের কথা পড়তে নেই, পড়লে অভিশাপে পাথর হয়ে যেতে হয়। আমি পাথর হয়ে যাই, তুমি কি চাও?
তারপর তিথি আর দাঁড়াল না। সুপারিবাগান পার হয়ে নদীর চড়ায় কাশবনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কেন যে গেল! তিথি কী চায়! সে কিছুটা দৌড়ে গিয়েও ফিরে এল। তার সাহস নেই। তিথির সঙ্গে নদীর চরে কাশের জঙ্গলে হারিয়ে গেলে বড় পাপ কাজ হবে। সে ধীরে ধীরে কাছারিবাড়িতে উঠে গেল।
ছয়
তারপর এ—দেশে ঋতু পরিবর্তনের পালা শুরু হল। চৈত্রমাসে নদীর চর যতদূর দেখা যায় ধুধু করছে। ফুটি তরমুজের চাষ সর্বত্র। হাওয়ায় ধূলিকণা ওড়াওড়ি করছে। গাছপালা সব গৈরিক রঙ ধারণ করছে। স্টিমার আসে না নদীতে। জল শুকিয়ে গেলে যা হয়। শীর্ণ জলধারা নদীর। পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি। তারপরই মেঘ গুরু গুরু—আকাশ মেঘমালায় ভরে যায়। কালবৈশাখীর ঝড়ে গাছের ডালপালা সব তোলপাড় হয়। আমবাগানে তিথি প্রায় সব সময় পড়ে থাকে। ঝোড়ো হাওয়ায় আম পড়লে মেয়েটা ত্বরিতে ছুটে আসে। আম কুড়িয়ে নেওয়ার এই মোহ থেকে অরণি বাদ যায় না। গাছ থেকে ঝুড়ি ভর্তি আম পেড়ে হরমোহন ভেতরে বাড়িতে দিয়ে আসে।
আজকাল অরণি যতটা পারে তুলিকে এড়িয়ে চলে। আমবাগানে তুলিও আসে। তার সঙ্গে বীণা পিসি। তুলি এসেই আর আগের মতো লাফায় না। কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে গেছে। অরণির তেজ তার সহ্য হয় না। অরণি তার পুতুলের বিয়েতে না খাওয়ায় ক্ষোভও কম না তার। সে সুযোগ খুঁজতে পারে।
—ধিঙ্গি হচ্ছিস দিন দিন—তোর কি না পুতুলের বিয়ে! এজন্য তুলি আমবাগানে কিংবা কাছারিবাড়ির আশপাশে বের হয়ে এলেই সে এক দৌড়ে বিশুদার ঘরে ঢুকে যায়। যেহেতু বিকেলবেলায় স্কুল থেকে ফিরে, কোনও খেলাধুলোর ব্যবস্থা থাকে না, ইচ্ছে করলে স্কুলের মাঠেও যাওয়া যায় না—ফুটবল খেলা আপাতত বন্ধ, বিশুদার ঘরে গেলে ক্যারাম পেটাতে পারে। তুলি সেখানে বড় যায় না। ছুটির দিনেই হয় মুশকিল, সারাটা দিন একা একা সে যে কী করে! তিথি তাকে গোপনে পাহারা দেয়, কারণ সে কাছারিবাড়ি থেকে বের হলেই টের পায় তিথি কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।
এক সকালে জগদীশ নদীর ঘাট থেকে প্রাতঃস্নান সেরে ফিরে এসে দেখলেন, অরণি খুবই মনোযোগ সহকারে অঙ্ক করে যাচ্ছে। অরণিকে বলা দরকার। চার—পাঁচদিনের জন্য তাঁকে শহরে যেতে হবে। ত্রিশ ক্রোশ রাস্তা, কিছুটা নৌকায়, কিছুটা হাঁটাপথে যেতে হবে। যেতে আসতেই প্রায় দুদিন কাবার। অরণিকে একা থাকতে হবে রাতে। তবে তিনি গোরাচাঁদকে বলে ব্যবস্থা করে গেছেন, গোরাচাঁদের মেয়ে তিথি রাতে তার ঘরে শোবে। অরণি কিছুই জানে না। মামলা—মোকদ্দমার ব্যাপার, উকিল—মুক্তার তাঁকে ছুটি না দিলে তিনি ফিরতে পারবেন না। বলি বলি করেও বলা হয়নি। এই মুহূর্তে না বললেও চলে না। কারণ আজই পুঁটুলিতে চিড়াগুড় বেঁধে তাঁকে রওনা হতে হবে।
তিনি তাঁর ভিজা গামছা দড়িতে মেলে দেওয়ার সময় বললেন, আমি আজ থাকছি না। বুলতা, কালীগঞ্জ হয়ে রাতে রাতে ধামগড় পৌঁছাব। সেখানে আমার রাত্রিবাস। সকালে উঠে আবার রওনা হতে হবে। কবে ফিরতে পারব জানি না, তবে চার—পাঁচদিনের আগে কাজ উদ্ধার হবে বলে মনে হয় না। তুমি সাবধানে থেকো। রাতে তিথি এ ঘরে শোবে। চিন্তা করবে না।
অরণি আগেই জানে, বাবা না থাকলে তিথি তার ঘরে রাতে শোবে। বাবাই তাকে কবে যেন বলেছিলেন। তখন অবশ্য তিথির থাকা নিয়ে তার কোনও সঙ্কোচ ছিল না। তবে ঋতুর রঙ বদলে গেলে বয়স যে এক জায়গায় থাকে না, শরীর এবং মন দুই—ই বিদ্রোহ করে। তিথি থাকবে শুনে, তিথিকে অবশ্য পরে বুঝিয়ে বললে হয়—দ্যাখ তিথি আমার ঘরে তোর থাকার কোনও দরকার নেই। বাবা সেকেলে মানুষ, সব সময় আমার কিছু বিপদ না হয়, এমন ভাবে। আমি একাই শুতে পারব। বিছানা করে দিয়ে তুই চলে যা, এইসব যখন ভাবছিল তখনই বাবা বললেন, সাঁজ লাগলে একা এই ঘরে তোমার না থাকাই ভালো। সেদিন কী হয়েছিল জানি না, দ্বিজপদও বললেন, ছেলেমানুষ, এমন পরিত্যক্ত আবাসে একা থাকলে ভয় পেতেই পারে। ভয়ে সে মূর্ছা গিয়েছে, দ্বিজপদ সার নিজের চোখে দেখেছেন, এভাবেই সব চাউর হয়ে যায়। সে যতই সেদিন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, দ্বিজপদ সারের অমোঘ কথা বাবা বিশ্বাস না করে পারেন না। নিজেকে গোপন করার জন্য সেদিন সে চাদরে শরীর ঢেকেও নিয়েছিল। কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে কি মূর্ছা যায়! দ্বিজপদ সার কেন যে বলতে গেলেন! শুধু বাবাকেই না, মনে হয় বাবুদের বাড়ির সবার কাছেই প্রচার হয়ে গেছে, অরণি অন্ধকারে তক্তপোশে পড়েছিল, কোনও হুঁশ ছিল না!