কমল বলল, ডাহা ফাঁকিবাজ সার। পড়ার নামে মাথায় বাজ পড়ে। কী করছে, কাছারিবাড়িতে! দেখে আসব সার?
দ্বিজপদ হাসলেন। আসলে পড়া থেকে ফাঁকি দেবার সুযোগ খুঁজছে। ভুঁইঞামশায়ের পুত্রটি পড়াশোনায় বেশ ভালো। পড়াশোনায় অরুর যথেষ্ট আগ্রহও আছে। যথাসময়েই সে চলে আসে। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকে আর কাউকে দেখতে না পেলেও, অরুকে দেখতে পান। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকলে সে উঠে দাঁড়ায়। নম্র স্বভাবের ছেলেটির পড়াশোনার ভার ভুঁইঞামশায় তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন, সে যদি না আসে, চিন্তারই কারণ। আমবাগানের এক কোনায় কাছারিবাড়িতে একাই তাকে থাকতে হয়। দ্বিজপদ কী ভেবে বললেন, ঠিক আছে। আমিই দেখে আসছি।
এতে সবাই একবাক্যে সায় দিল, সেই ভালো সার।
অর্থাৎ তিনি যতক্ষণ না থাকবেন, ততক্ষণই তাদের রেহাই।
বিশু বলল, আমি যাব সঙ্গে।
কী দরকার!
কমল বলল, টর্চ নিলেন না?
তা সাপখোপের উপদ্রব আছে। নদীর পাড়ে বাড়ি। ঝোপজঙ্গল, কোথাও কোথাও প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপও আছে। বিষধর ভুজঙ্গের উৎপাতও কম না। তিনি কী ভেবে টর্চ বাতিটা সঙ্গেই নিলেন।
ঘর থেকে বের হলেই দুটো করবীফুলের গাছ, তারপর একটা হাসনুহানার গাছ। গাছটায় দু—একটাই ফুল ফোটে। ফুলের তীব্র গন্ধ ছড়ালেই বোঝেন, গাছে কোথাও ফুল ফুটেছে। গাছটা মাথায় আনারসের ডিগের মতো লম্বা ঘন পাতায় ঝোপ সৃষ্টি করে রেখেছে। গাছটার নিচ দিয়ে যাবার সময় তিনি খুব সতর্ক থাকেন। কেন যে মনে হয় যে—কোনও মুহূর্তে পাতার ঝোপ থেকে পোকামাকড় লাফিয়ে পড়বে। খুবই দুর্লভ ফুলের গাছ। দিনের বেলাতেও ফুল খুঁজে বের করা কঠিন—অথচ ফুল যে ফুটেছে, গন্ধেই টের পাওয়া যায়। বিষধর সাপেদের বড় প্রিয় এই ফুলের ঘ্রাণ। একেবারে রাস্তার উপর গাছটা জমিদারবাবুরা না লাগালেই পারতেন। তিনি কী ভেবে গাছটার নিচে ঢুকে যাবার আগে টর্চ মেরেও দেখলেন। প্রায় বিশাল ছত্রাকার হয়ে আছে গাছের মাথাটি। ঘন সবুজের সমারোহ।
গাছটা পার হলেই সবুজ লন। শীত বসন্তে নীল রঙের বেতের চেয়ার টেবিল পাতা থাকে। বাবুরা বিকালে হাওয়া খান এখানটায় বসে। নদীর জলে নৌকা ভাসে। রাতে স্টিমারের সার্চলাইটে কেমন নীলাভ দেখায় এলাকাটা। বাবুদের আত্মীয়স্বজনও কম না। এখানে বসে তাস পাশার আড্ডাও জমিয়ে তোলার ব্যবস্থা থাকে।
দ্বিজপদ যাচ্ছিলেন, তার ছাত্রটি কাছারিবাড়িতে একা একা কী করছে, শরীর যদি খারাপ হয়, এই সব ভেবেই আমবাগানে ঢুকে গেলেন। এক ইটের দেয়াল, মাথায় টিনের চাল, আটচালার উপরে গাছের ডালপাতায় জায়গাটা খুবই অন্ধকার হয়ে আছে। মূল বাড়ি থেকে বড়ই আলগা কাছারিবাড়িটা। অরু ছেলেমানুষ সে এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় একা বসে থাকতেও ভয় পাবে।
সে কি ঘরে নেই?
দরজা খোলা?
টর্চ মেরে দূর থেকেই সব টের পাচ্ছেন।
কেউ হারিকেনও জ্বালিয়ে দিয়ে যায়নি।
দ্বিজপদ কিছুটা দ্রুতই হেঁটে যেতে থাকলেন।
ঘরে ঢোকার আগে ডাকলেন, অরু আছিস! অরু।
কোনও সাড়া নেই।
তাজ্জব। ছেলেটা গেল কোথায়?
ভেতরে টর্চ মারতেই দেখলেন, অরু শুয়ে আছে একটা লম্বা সাদা চাদরে মুখ মাথা ঢেকে। সে কি ঘুমোচ্ছে!
এই অসময়ে!
এই অরু, অরু।
অরু ধড়ফড় করে উঠে বসল।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস, কী ব্যাপার, শরীর খারাপ!
টর্চের আলো চোখে পড়ায়, অরু তাকাতে পারছিল না। সে হাতে চোখ আড়াল করে বোঝার চেষ্টা করল, কে তাকে ডাকছে!
তার যে কী হয়েছিল! সে কী বলবে। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া তার যেন আর অন্য কোনও উপায় নেই। সার নিজে চলে এসেছেন। এতে সে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠল। সে ঘরে কখন ঢুকে গেছে, কখন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল—শরীরে তার যেন কীসের ঘোর উপস্থিত। চোখ মুখ জ্বালা করছিল, এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আশ্চর্য এক ঝড়ের আভাস। ঝড়ে তাকে বড়ই বিপর্যস্ত করে দিয়ে গেছে—সে কিছুটা যেন চৈতন্যও হারিয়েছিল—এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীতে সে স্বপ্নের বালিহাঁস হয়ে গেছিল। কোনও শিকারের দৃশ্য, সে মজবুত হাতে হাঁসটার ডানা, কিংবা পালক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।
লজ্জায় সে কথা বলতে পারছিল না।
কী হয়েছে? শরীর খারাপ অরু?
আজ্ঞে। সে কথা বলতে পারছে না।
ভয় পেয়েছিস?
আজ্ঞে… সে কথা বলতে পারছে না।
ঘরে হারিকেনও জ্বালিসনি!
আজ্ঞে আমি যাচ্ছি সার।
আয়। তোর একা থাকতে ভয় করলে, কারও এ—ঘরে থাকা দরকার। সত্যি তো, তুই থাকিস কী করে। ঠিক আছে, ভুঁইঞামশায়কে বলছি।
আজ্ঞে না সার বলবেন না। আমার একা থাকতে ভয় করে না। আপনি বাবাকে কিছু বলবেন না।
হারিকেন ধরা।
সে চকি থেকে নেমে হারিকেন ধরাল।
এখন তার ধীরে ধীরে সবই মনে পড়ছে। তিথি হারিকেনের চিমনি মুছে তেল ভরে রেখে গেছে। দরকারে সে জ্বালিয়ে নেয়। নিবিয়ে দেয়। আজ ঘরে ঢুকে কিছুই মনে ছিল না। শরীরে ঘোর উপস্থিত হলে এমনই বুঝি হয়—সে তার দ্বিতীয় সত্তা আবিষ্কার করে কেমন নির্বোধ হয়ে গেছে আজ।
সে খুবই ধীর পায়ে বই খাতা নিয়ে ঘর থেকে বের হবার আগে আলো কমিয়ে দিল হারিকেনের। তারপর দ্বিজপদ সারের পিছনে প্রায় চোরের মতো হেঁটে যেতে থাকল। তার মনেই থাকল না, তুলি তার পুতুলের বিয়েতে খেতে বলেছে। বড়লোকের মেয়ে তুলি, তার পুতুলের বিয়ে—সেখানে একমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথি বোধহয় সেই ছিল। কারণ সকালে তিথির গালিগালাজে প্রায় ভূত ভেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। তুমি কী অরুদা! ছোড়দি কত আশা নিয়ে বসেছিল, তোমাকে সে সামনে বসিয়ে লুচি পায়েস খাওয়াবে। তুমি পাত্তাই দিলে না। ভুঁইঞাকাকার সঙ্গে রান্নাবাড়িতে খেতে ঢুকে গেলে! তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।