অরণি হতভম্ব। বুঝতে পারছে না, সে হাসবে না রাগ দেখাবে। আমি কী করব, কী নিয়ে থাকব—এত পাকা পাকা কথা মেয়েটার, এটুকুন মেয়ে কেমন সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তিথির পক্ষেই সম্ভব?
নে ওঠ। ঘরে চল। যে হাতে সব তছনছ করেছিস সেই হাতে সব সাজিয়ে রাখ। স্টিমারঘাট থেকে বাবা ফিরে এলে মুশকিলে পড়ে যাবি।
তিথি হি হি করে হাসতে হাসতে উঠে বসল, তারপর ছুটতে থাকল, যেন সে জয়লাভ করে খুবই খুশি—ছোটার মধ্যে তিথির এত সজীবতা থাকে যে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এক বিনুনি বাঁধা, মার্কিন কাপড়ের ঢোলা সেমিজ গায়ে, উসখোখুসকো চুলে মেয়েটার লাবণ্য যেন আরও বেড়ে যায় তখন। আর তখনই মনে হয়েছিল, তিথি চিৎ হয়ে পড়ে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ঠিক, আবার সঙ্গে সঙ্গে এমন চোখে ওকে দেখছিল যেন কিছু একটা হয়ে যাক। আর কিছু না হোক, অরুদা তাকে আদর করলে সে আপত্তি করবে না।
এই সব মনে হলেই তিথির জন্য তার কষ্ট হয়। সে ধীরে ধীরে হাঁটে। তার কিছু ভালো লাগে না। অমলদা যাবার সময় তাকে ডেকে গেছে, এই অরু ঘাটলায় গিয়ে আবার বসলি কেন? পড়াশোনা নেই।
সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু গোলঘরে সবাই পড়তে চলে যাবে। তাকেও হাতমুখ ধুয়ে মাস্টারমশাইর সামনে গিয়ে পড়তে বসতে হবে, সে না গেলে দাদারাই খুঁজতে বের হবে। কাছারিবাড়িতে এসে খুঁজবে তাকে।
সে পা চালিয়ে হাঁটছে। সুপারিবাগান পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকতেই মনে হল কারা যেন মাঠে তার জন্য অপেক্ষা করছে। কাছে গেলে দেখল তিথি আর তুলি। তুলিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে তুলির ভাব না হলে তিথি বোধহয় স্বস্তি পাচ্ছিল না।
তিথি বলল, কোথায় একা একা ঘুরছিলে। জানো সাঁজবেলায় তেঁতুলতলা দিয়ে কেউ আসে না। জায়গাটা ভালো না। একা একা তেঁতুলতলা দিয়ে চলে এলে!
আসলে রাস্তা সংক্ষিপ্ত করার জন্যই সে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তেঁতুলতলার নিচ দিয়ে উঠে এসেছে। জায়গাটা যে ভালো না সেও শুনেছে। ছোটপিসিকে এখানে একবার ভূতে ধরেছিল—সাঁজ লাগলে রাস্তাটা দিয়ে কেউ বড় আসে না। তুলির আক্রোশের কথা ভাবতে গিয়ে এতই দমে গিয়েছিল, তার কোনও কিছুই প্রায় খেয়াল ছিল না। সেই তুলি অরুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক, তবে তাকে দেখছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয় কোনও নক্ষত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন।
তিথি না পেরে বলল, এই ছোড়দি, অরুদাকে কী বলবে বলেছিলে?
কী বলব?
কেন, বললে না, চল তো, অরুর সঙ্গে আমার কথা আছে।
কখন বললাম?
জানি না বাপু, তা হলে আসার কী দরকার ছিল। অরুদা তুমি যাও। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসোগে।
অরু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে পা বাড়াতেই তুলি বলল, সেদিন মাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে কী দেখছিলে?
কবে?
মনে নেই তোমার। আমি চরের বালিতে বাণীপিসির সঙ্গে হাওয়া খাচ্ছিলাম।
অরু সোজাসুজি বলল, না। মনে নেই।
না, আচ্ছা নাই মানলাম। তারপরই বলল, আমি বাঘও নয় ভালুকও না। আমার সঙ্গে কথা বললে জাত যাবে না। কি মনে থাকবে?
কী কথা বলব?
কথার কি শেষ আছে। আমাকে চুরি করে দেখলে খুব রাগ হয় আমার জানো?
ঠিক আছে আর দেখব না।
তিথি বলল, তুমি ছোড়দিকে তবে সত্যি চুরি করে দ্যাখো!
কী বলব, ও যখন বলছে—
ও বললেই তুমি মেনে নেবে। এ কেমন কথা। চুরি করে দেখার কী আছে!
অরু কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই চুরি করে দেখার মধ্যে কি কোনও অন্য অনুভূতি কাজ করে। সে বড় হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে যতই আড়াল করে রাখুক তার ভেতর একজন নারী যে স্বপ্নে বড় হয়ে উঠছে বুঝতে পারে। এই সব গোপন কথা যদি সত্যি ফাঁস হয়ে যায়, তবে সে মুখ দেখাবে কী করে! বাবা যে তবে খুবই জলে পড়ে যাবেন। সেদিনের ছেলে, ক্লাশ এইটে সে পড়ে, তার মধ্যে একজন নারী স্বপ্নে বড় হয়ে উঠলে যে রোগব্যাধির পর্যায়ে পড়ে। কলঙ্কও কম না।
তখনই তুলি বলল, আমি কাউকে কিছু বলতে যাচ্ছি না। আমার পুতুলের বিয়ে আজ। তুমি খাবে। তিথি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। না গেলে রাগ করব।
পুতুলের বিয়ে নিয়ে অরুর এক ধন্দ। সে খাবে। কী খাবে? সে যাই হোক অরু বুঝল, সে তুলিকে দেখে যা ভাবে, তুলিও তাকে দেখলে তেমনই কিছু একটা ভাবে। তুলি তার বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু রটাতে সাহস পাবে না। তুলি নিজেও ভেতরে ভেতরে বড় হয়ে যাচ্ছে। তুলিও তার শরীর নিয়ে ঠিক কিছু ভাবে।
এভাবে সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকারে অরুর মুখ রক্তাভ হয়ে গেল। ভেতরে এক অতীব স্পৃহা শরীরের কোষে কোষে ঢেউ তুলে দিচ্ছে। সে কোনওরকমে কাছারিবাড়িতে ঢুকে তক্তাপোষে বসে পড়ল।
হাতমুখ ধোয়ার কথা মনে থাকল না।
কেমন ভ্যাবলু বনে গেছে যেন।
মনে হয় তার জীবনে এই প্রথম এক পালতোলা নৌকা এসে হাজির। নৌকায় উঠে গেলেই এক রহস্যময় দেশ, শরীরে সুঘ্রাণ—হাতে পায়ে জংঘায় পদ্মফুলের ছড়াছড়ি। নরম পাপড়ি, কোমল ত্বকের ভিতর ফুটে থাকা নরম স্পর্শে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সে হাত পা টান করে একটা বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে তার শরীর।
তখনই দ্বিজপদ সারকে অরুর নামে নালিশ।
সার দিন দিন অরু ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে। এখনও তার আসার নামগন্ধ নেই। কখন পড়তে বসবে!
দ্বিজপদ বুঝতে পারেন, যতক্ষণ তিনি পড়ান, ততক্ষণ বাবুদের ছেলেরা হাজতখানায় বসে থাকে। অরু না আসায়, তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। হাজতখানার আর এক কয়েদির পাত্তাই নেই। সার শুধু একবার বলেছিলেন, অরুর শরীর খারাপ।