তুলি ঠিক টের পেয়েছে সে তাকে দেখে, তাকে দেখার জন্য নদীর পাড়ে কিংবা কাছারিবাড়ির বড় বড় আমগাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও বাবুদের সঙ্গে স্টিমারঘাটে গেলেও সে যে তুলির পিছু নেয়, তাও টের পেতে পারে। কখনোই তুলির সামনে যেতে সাহস পায়নি। রান্নাবাড়িতেই কখনও রাতে সে কাছ থেকে তুলিকে দেখতে পায়। রোজদিন দেখা হয় না। তুলি আগে খেয়ে নিলে দেখা হওয়ার কথাও নয়, তার যে কি হয়, সে রান্নাবাড়িতে মাথা নিচু করেই খায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে কত বড় বেয়াদপি, সেটা সে বোঝে। তুলি অপছন্দও করতে পারে। বাড়ির একজন আমলার পুত্রের এত আস্পর্ধা হয় কী করে! সাটিনের ফ্রকের নিচে তুলি আজকাল টেপ দেওয়া জামাও পরে।
তুলির এত সে জানে, তুলি কেন জানবে না, তুলিকে দেখলেই সে পালায়।
কাছারিবাড়ির দিকে সে হেঁটে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে তার কমই দেখা হয়। বাবার ছুটিছাটা নেই। রবিবার শনিবার নেই। সেই আটটায় গিয়ে নাজিরখানায় বসেন, তক্তাপোশে সাদা ধবধবে ফরাস পাতা—দু—তিনটে তাকিয়া, সামনে কাঠের একটা বড় ক্যাশবাক্স, দেয়ালের দিকে গোটা দুই লম্বা টুল, লোকজন সব সময় বাবার কাছে বসেই থাকে—আদায়পত্র, কিছু সুদেরও কারবার আছে, নদী থেকে বড় রকমের রোজগার আছে বাবুদের—নদীর ডাক হয়—ইলিশমাছের জো পড়লে আদাইয়ের পরিমাণ বাড়ে।
সকালবেলাতেই ভেতর বাড়ি থেকে একটা লম্বা ফর্দ চলে আসে। বাবা ফর্দ মিলিয়ে সব কিছু নিয়ে আসার জন্য হরমোহনকে বাজারে পাঠিয়ে দেন। যার যা দরকার, বাবার কাছে দরকারমতো চিরকুট আসে। লম্বা খেরো খাতায় বাবা সব খরচখরচা এবং আদায় কী হল সব টাকার জমা খরচ তুলে রাখেন। সাঁজবেলায় দেবকুমারবাবু কিংবা নবকুমারবাবুর কাছে সারাদিনের খরচ খরচা এবং আয়ের হিসাব অর্থাৎ খেরো খাতাটি সম্বল করে বাবা তাদের কাছে চলে যান। মামলা মোকদ্দমা অথবা তালুকের প্রজাদের বাদবিসংবাদে বাবাকেই ছুটতে হয়।
যত তার কথা রাতে।
তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো অরু?
আজ্ঞে না।
বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে না তো?
আজ্ঞে না।
মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। পড়া বুঝতে না পারলে দ্বিজপদকে বলবে।
তখনই একদিন সে তার বাবাকে কেন যে বলল, আচ্ছা বাবা আমার জামাপ্যান্ট আমি কেচে নিতে পারি না।
পারো।
সকালে তিথির জল তুলে দিয়ে যাওয়ার কিন্তু দরকার হয় না। আমিই তুলে রাখতে পারি।
ইচ্ছে করলে সবই করা যায় অরু। এতে সাবলম্বী হওয়া যায়। সবকিছু নিজে করে নিতে পারার মতো বড় কিছু নেই।
আমি তিথিকে ঘরে ঢুকতে বারণ করে দেব।
কেন? সে কী করেছে।
কিছু করেনি। তিথির কত কাজ ভেতর বাড়িতে। সে সব করে কখন?
অঃ এই কথা। তবে তিথি কি দমবার পাত্র। আমার তো মনে হয় না রাজি করাতে পারবে।
বাবার কথাই ঠিক।
সে তিথিকে নিষেধ করেছিল।
শোন তিথি, এই কাজটুকু তোর না করলেও চলবে।
তিথি বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
জলটল আমিই তুলে রাখব। বিছানা করে নিতে আমার অসুবিধা হবে না। জামাপ্যান্ট গোলা সাবানে কাচতে কতটুকু সময় লাগে বল।
ঠিক আছে করে নেবে। করতে পারলে তো ভালোই। তারপরই তিথি সিঁড়ি ধরে নামার সময় ভেংচি কেটে বলল, কত মুরদ। জানা আছে। তিনি সব করে নেবেন তা হলেই হয়েছে!
কিন্তু তিথি বোধহয় শেষে অবাকই হয়ে গেছিল, সে তো ছেড়ে দেবার জন্য বসে নেই। তিথি যখন দেখল, কোনও কাজেই তার ত্রুটি থাকছে না, কেমন দিন দিন বিমর্ষ হয়ে যেতে থাকল। স্কুলে যাবার সময় দেখতে পায় তিথি সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, স্কুল থেকে ফিরেও দেখতে পায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কাজের কোনও খুঁতই ধরতে পারছে না, ক্ষোভে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আর একদিন এসে দেখল, সারা ঘর তছনছ করে রেখেছে কে! মেঝেতে বালতির সব জল ঢেলে দিয়েছে কেউ। ঘরে ঢুকেই অরুর মাথা খারাপ। তিথির কাজ। তিথিই শেকল খুলে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে। কাজ কেড়ে নেওয়ায় তার বোধ হয় সহ্য হচ্ছে না।
তিথি! তিথি!
সে দরজার বাইরে লাফিয়ে নেমে গেল।
তারপর তিথিদের বাড়ির দিকে ছুটল।
না কোথাও তিথি নেই।
কোথায় গেলে মেয়েটা?
অরণি কাউকে বলতেও পারছে না, আমার ঘর তিথি তছনছ করে দিয়েছে। বইটই পেনসিল খাতা সারা চকিময়। জলে ভাসছে মেঝে। কাঁসার ঘটি গেলাস গড়াগড়ি খাচ্ছে চকির নিচে। এটা যে তিথিরই কাজ বলে কি করে!
শেষে সে তিথিকে খুঁজে পেল সুপারিবাগানের ভেতর। গাছগুলো খুবই পাতলা, দূর থেকেও দেখা যায় ভেতরে কেউ বসে থাকলে। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীতে। নদীর জল তেমনি ছলাত ছলাত। পাড় ভাঙারও শব্দ পেল। হরিশবাবুর ঘোড়াও ছায়ার মতো দূরে ভেসে উঠল।
অরু ছুটে যাচ্ছে।
সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে সোজা ছোটা যায় না। সে এ—গাছ ও—গাছ ডাইনে বাঁয়ে ফেলে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে।
আর ডাকছে, এই তিথি, এখানে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পাবি ভাবছিস! তোর বাবাকে ডেকে সব না দেখাচ্ছি তো আমার নাম অরণি না। তোর এত জেদ!
এই কি, কাছে গিয়ে কী দেখছে!
তিথি গাছের গুঁড়িতে বসে আছে মাথা নিচু করে। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না।
অরু জোর করে মুখ দেখার জন্য তিথিকে চিৎ করে দিল। তিথি বিন্দুমাত্র জোরাজুরি করল না। কারণ তিথি বোকার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে—আমি কী করব বলে দাও। আমি কী নিয়ে থাকব বলে দাও।