তারপরেই মনে হয় কাজ করলে মানুষ ছোট হয়ে যায় না। হাতে র্যাকেট নিয়ে সেও খেলবে। খেলার নামে তার মধ্যে ঘোর সৃষ্টি হয়। নদীর পাড়ে যখন তারা নেট টাঙিয়ে খেলছিল, তখন আর নিজেকে কিছুতেই খাটো ভাবতে পারেনি। ফেরার সময় মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরছে।
তবে তুলি বাবাকে মিছে অভিযোগ করে মার খাওয়াবার পরিকল্পনা করছে, ভাবতেই ভারী দমে গেল। তুলির সঙ্গে যাও ইচ্ছে হয়েছিল, দেখা হলে একদিন কথা বলবে, তাও আর বোধহয় হবে না। কি বলতে কি ভেবে নেবে কে জানে। আর তুলিকে সে কী কথা বলবে? তুমি ভালো আছো? তুমি দেখতে খুব সুন্দর। খুব বোকা বোকা কথা! তুলির সঙ্গে কথা বলার মতো ভাষাই তার জানা নেই।
সবাই চলে গেছে, নদীর পাড়ে মানুষজন কমে আসছে, দূরে স্টিমারঘাটে গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাটে যাত্রীদের ভিড় আছে। রাত আটটায় স্টিমার আসবে, যাত্রী নামবে, যাত্রী উঠবে। আশরাফ সারেঙ জাহাজ ভর্তি করে লোক তুলে নিয়ে যাবে। তার খুবই ইচ্ছে হয়েছিল, আশরাফ সারেঙের সঙ্গে ঘাটে গিয়ে একদিন দেখা করে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। গোলঘরে তখন সবার সঙ্গে তাকেও পড়তে বসতে হয়। মাস্টারমশাই প্রাসাদের বড় বড় জানালা দেখিয়ে বলেন, এই হচ্ছে আয়তক্ষেত্র। ঘরের মেঝে দেখিয়ে বলেন, এই হল বর্গক্ষেত্র—যার চারটি বাহুই সমান।
পড়াশোনার পীড়নও কম নয়। ক্লাশে পড়া না পারলে ঠিক বাবার কানে কথা উঠে যায়।
ভুঁইঞামশায় আছেন?
দ্বিজপদ সার এসে হাজির।
তোমার বাবা কোথায়।
সে বুঝতে পারে দ্বিজপদ সার নালিশ জানাতে এসেছেন। সে দরজা খুলে সামনের বারান্দায় একটা টিনের চেয়ার বের করে দেয়। তারপর বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। ইংরেজি গ্রামার ট্রানস্লেশনে সে কাঁচা, তার নাকি মনোযোগেরও অভাব আছে—দ্বিজপদ সার সে—সব কথা বলতেই হয়তো এসেছেন। সে তার বাবাকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায়।
এভাবে সে কতদিন কত কারণে নদীর পাড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাছারিবাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে হয় না। বাড়ির জন্য মন কেমন করে তখন। পূজার ছুটিতে সে বাড়ি যেতে পারবে, পূজার তো এখনও অনেক দেরি। নতুন উপসর্গ তুলি। তাকে ভয় দেখিয়েছে, তুলি মিছে কথা বলে না। তুলি কাউকে ভয় পায় না। ভয় না পেলে যেন মিছে কথা বলা যায় না।
নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। জোয়ারে নদীর জল বাড়ছে। দেখতে না দেখতে বর্ষা এসে যাবে। বর্ষায় নদী বিশেষ করে এই কোয়ালা নদীতে কুমির পর্যন্ত ভেসে আসে। তিথিই তাকে একদিন খবর দিয়েছিল, জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরীর বৈঠকখানার বারান্দায় শ্বেতপাথরের টেবিলে একটা কুমিরের ছাল আছে। তিথি তাকে সেখানে একদিন নিয়ে যাবে, এমনও কথা দিয়েছে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কথা মনে হয়। আর কত পাখির ওড়াউড়ি, কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় সে কিছুই জানে না। বর্ষা এলে দু—পাড়ের চর ডুবে যায়। নদীর ঘাটগুলিতে যত সিঁড়ি আছে সব জলে ডুবে যায়। তিথিই সব খবর দেয় তাকে। কিন্তু তুলির খবরটা না দিলেই পারত। এমন সুন্দর মেয়েটা এত কুবুদ্ধির ডিপো ভাবতেই তার কষ্ট হচ্ছিল।
তবে বাবা তাকে কখনোই গায়ে হাত তোলেনি। বাবাকে বলে মার খাওয়ানো সহজ না। বাবা কি পুতুল! সে সাহস পায়। ঘাটলার সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায়। আকাশ আর মেঘমালায় ঢেকে আছে চারপাশ। দুটো একটা নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব জলে ভাসছে। ছলাত ছলাত জলের শব্দ। গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাঝিরা। কত দূর দেশে চলে যায় কত লোক। সেও চলে এসেছে—তিথির জন্যই হোক কিংবা এই গ্রাম, মাঠ, স্কুল, মজা খাল বিশাল সব প্রাসাদ আর বাবুদের জাঁকজমক, যেমন জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরীর আস্তাবলে বিশাল দুটো আরবি ঘোড়া এবং ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড় ধরে হরিশবাবুর ছোটা, যে না দেখেছে, সে জানেই না, এক আশ্চর্য অশ্বারোহী কদম দিতে দিতে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যেতে পারে। হরিশবাবু দেশে এলে তিথি তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ছুটে যাবেই কারণ হরিশবাবু বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে বের হন। তিথি তাকে গোপনে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। চিরকুটে কী লেখা থাকে সে জানে না। তিথি চিরকুট হোক, চিঠি হোক খুবই গোপনে হরিশবাবুর হাতে দিয়ে দেয়। ঠিক ঘাটলার পাশে কদম দিতে দিতে তিথির সামনে এসে দাঁড়াবেন। তারপর ভারী সতর্ক নজর। ঘোড়ার উপরেই তিনি বসে থাকেন। নুয়ে তিথির চিঠিটা নিয়েই দিঘির পাড় ধরে অদৃশ্য হয়ে যান।
আসলে অরুর মাঝে মাঝে কেন জানি মনে হয় কোনও স্বপ্নের পৃথিবীতে সে এসে উঠেছে। বাড়ির জন্য প্রথম প্রথম খুবই মন খারাপ করত, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, তত তার মনে হয় মন খারাপ আর আগের মতো হয় না। সে তো দেখতে পায় তুলি সাটিনের ফ্রক গায় দিয়ে মাথায় সুন্দর লাল রিবন বেঁধে কখনও সুপারিবাগানে, কখনও নদীর চরে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে কেউ থাকে। সে কাছে থাকে না, ঝোপজঙ্গলের আড়াল থেকেই সে তুলিকে দেখতে বেশি ভালোবাসে। তুলি কাছাকাছি এলেই সে দৌড়ে পালায়—যদি তুলি টের পেয়ে যায়, সে চুরি করে চরের উপর একটা জ্যান্ত পরীর ওড়াউড়ি দেখছিল—ধরা পড়লে কেলেঙ্কারির একশেষ—সে না পালিয়ে থাকে কী করে!
তুলি মিছে কথা বলে না, তিথি ঠিকই বলেছে।