সাঁকোর ঠিক নিচে এসে জগদীশ বলেছিলেন, জুতো খুলে নাও অরু। আমরা সোজা সাঁকো পার হয়ে যাচ্ছি না। আমরা যাব দক্ষিণে। সোজা গেলে দনদির বাজার পড়বে। আরও দূরে নদীর পাড়ে প্রভাকরদি। গঞ্জ মতো জায়গা। ওখানে মেলা পাটের আড়ত আছে। একটা বড় সাঁকো আছে। বড় হলে সবই জানতে পারবে। আমরা এবার মাঠে নেমে যাব। কিছুটা রাস্তা জলকাদা ভাঙতে হবে।
অরণি সাঁকোর উঁচু জায়গা থেকে খালের পাড়ে দৌড়ে নেমে গিয়েছিল। ঘাস পাতায় ঢাকা রাস্তা, তারপর আরও নিচে ধানখেতের লম্বা আল পড়েছে দেখতে পেল। এই আলের রাস্তায় নওঁগা পর্যন্ত হেঁটে না গেলে সড়কে ওঠা যাবে না। সকালের দিকে ঠান্ডার আমেজ থাকে। সূর্য উঠে গেছে। ঘাসে শিশির পড়ে আছে। ধানের জমিগুলো হলুদ রঙের—যতদূর চোখ যায় মনে হয়েছিল হেমন্তের মাঠ বড় নিরিবিলি।
অবশ্য আলের রাস্তায় বকের মতো পা ফেলে কিছুটা হেঁটে আসতেই দেখতে পেল— সামনের জমি সব উঁচু। রাস্তায় জলকাদাও নেই—দু—পাশের জমিতে কলাই সর্ষে বুনে দেওয়া হয়েছে। কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠছিল, দূরে একটি নদী আছে টের পেল—এবং এটা যে ছাগলবামনি নদী অরণি জানে। নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেলে পায়ের কাদা ধুয়ে আবার জুতো পরে নেওয়া যেত, কিন্তু জগদীশ তাকে নিয়ে সেদিকে গেলেনই না। সোজা সামনে তিনি বেশ দ্রুত পায়েই হেঁটে যাচ্ছেন, এবং দম ফেলতে না ফেলতেই ফের সেই কাদাজল ভাঙা—ধানজমির মাঠ উঁচুনিচু হয়ে আছে—সামনের দিগন্ত প্রসারিত মাঠের শেষ দিকটায় বাবা আঙুল তুলে বললেন, আর ঘণ্টাখানেকের পথ, ওখানে আমাদের শেষ সাঁকোটি পার হতে হবে। নদীর জলে ইচ্ছে করলে পা ধুয়ে নিতে পারবে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতেই বলেছিলেন, বারদীর আশ্রমে আমাদের একটু তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়া দরকার। আশ্রমের বাল্যভোগ প্রসাদ পা চালিয়ে না হাঁটলে পাবে না। বাল্যভোগ তুমি খেয়েছ, তবে স্মৃতিতে সে অমৃতস্বাদের কথা মনে নাও থাকতে পারে। একবার তোমাদের সবাইকে নিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসে বাবা লোকনাথের উৎসবে এসেছিলাম—তোমার কি মনে পড়ে।
অরণির কিছুই মনে নেই।
সে বলেছিল, কবে?
তখন তুমি খুবই ছোট। তোমার মা মানত করেছিল, আশ্রমে মিসরি বাতাসা ভোগ দেবে। তোমার ঠাকুমা তখন বেঁচে।
অরণি আর কোনও কথাই বলছিল না। কারণ ঠাকুমার কোনও স্মৃতি তার মনে নেই। আর সে ভেবে পাচ্ছিল না, বাবা তার সঙ্গে আজ এত কথা কেন বলছিলেন!
যেমন জমির কথা।
যেমন ঋতুর কথা।
যেমন এই মাঠ এবং গ্রামগুলো সম্পর্কে শোনা কথা।
জগদীশ বলেই চলেছেন, আশেপাশের গ্রামগুলোর নামে অদ্ভুত মিল আছে। যেমন ধরো আমরা বল্লভদি পার হয়ে এলাম—পূর্বে গেলে সুলতানসাদি, দক্ষিণে গেলে বাণেশ্বরদি, বারদি, হামচাদি, দামোদরদি। সব গ্রামের শেষে ‘দি’ শব্দটি আছে। আসলে ওটা ‘দি’ হবে না। ‘ডিহি’ হবে। জলা দেশ, আমাদের পূর্বপুরুষরা এই জলা দেশে মাটি ভরাট করে বাড়িঘর বানিয়েছিলেন। দেখবে সবার বাড়ির সামনেই একটা করে পুকুর আছে। মাটি তুলে নেওয়ার প্রয়োজনেই পুকুর কাটতে হয়েছে। মাটি তুলে ডিহি তৈরি করে বসতবাড়ি গড়া হয়েছে। যত উত্তরে যাবে সব ‘দি’। ব্রাহ্মণনদী, মনোহরদি, গোপালদি, নরসিংদি। তোমার পায়ে কি লাগল!
না বাবা!
বসে পড়লে কেন! অরণি দেখেছে বাবা তাকে গুরুত্বপূর্ণ কথায় কখনো সখনো তুমি বলে, আবার কখনো তুইতোকারিও করেন। আজ বাবা একটু বেশি মাত্রায় তুমি তুমি করছেন। অরণি পা থেকে জড়ানো কিছু যেন তুলে নিচ্ছে। বোধ হয় লতাপাতা কিছু জলকাদা ভাঙতে গিয়ে পায়ে জড়িয়ে গেছে।
জলা জায়গায় পোকামাকড়ের উপদ্রব এমনিতেই বেশি মাত্রায়। যদি জোঁকের উপদ্রবে পড়ে যায় অরু—জগদীশ নুয়ে দেখলেন, শ্যাওলা জাতীয় কিছু পায়ে আটকে গেছে। কাদা শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ের গোড়ালিতে টান ধরে যেতে পারে। হাঁটতে অস্বস্তি হতে পারে। প্রায় হাঁটুর কাছেও কাদার দাগ। তিনি বললেন, আর বেশি দূর না। এবারে আমরা নওগাঁর সড়কে উঠে যাব। নওগাঁর শচীন ডাক্তারের কথা মনে আছে?
অরণি বলল, আছে। সোম শুক্র সাইকেলে আমাদের বাড়ি যেতেন।
তা হলে মনে করতে পারছ। দীর্ঘদিন কালাজ্বরে ভুগে ভুগে বড়ই রুগণ হয়ে পড়েছিলে। তোমার গায়ের রঙও পুড়ে গিয়েছিল—আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস শচীন যুদ্ধফেরত সোজা দেশে চলে এসেছিল—তা না হলে কী যে হত! খবর পাঠাতেই সোজা এসে দেখে গেল তোমাকে। নওগাঁতেই তার বাড়ি।
আমার সবই মনে আছে বাবা। তিনি আমাকে ব্রহ্মচারী ইনজেকসান দিতেন। সপ্তাহে দু—বার।
ঠাকুরের কৃপায়, আর শচীন ডাক্তারের হাতযশে সেবারে তুমি আরোগ্য লাভ করলে। শচীন কিন্তু পাশ করা ডাক্তার না। আর পাশ করা ডাক্তার পাওয়াই যে কঠিন। দশ পনেরো ক্রোশের মধ্যে একজনও নেই। পাঁচদোনার মল্লিক বাড়ির ছেলে অমিয় শুনেছি কলকাতা থেকে এল এম এফ পাশ করে এসেছে। খুবই বড় ডাক্তার। তবে সে গাঁয়ে বসছে না। শহরেই ডিসপেনসারি খুলেছে। শচীনই আমাদের ব্রহ্মা বলো বিষ্ণু বলো, মহেশ্বরও বলতে পারো—একমাত্র পরিত্রাতা। তোমার এত বড় কঠিন অসুখ সেই নিরাময় করে তুলল। সামনে যে গাছপালা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই শচীন থাকে। গ্রামটি খুবই বর্ধিষ্ণু। গাঁয়ে একটি পোস্টাফিসও আছে। তবে পাকা বাড়ি নেই। কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না। বারদী গাঁয়ে ঢুকলেই পাকা বাড়ি কেমন হয় বুঝতে পারবে। এই অঞ্চলে একমাত্র বারদী গ্রামেই চৈতন্য নাগের প্রাসাদতুল্য কোঠাবাড়ি আছে—স্টিমারঘাটে যাওয়ার রাস্তায় দেখতে পাবে। আর একটু কষ্ট করে পা চালিয়ে হাঁটো। সড়কে উঠে গেলে আর জলকাদা ভাঙতে হবে না।