না, আসছি না। আগে আয়।
অরু স্কুলের জামাও ছাড়েনি। এত নজর মেয়েটার। কখন সে ফিরবে, সেই আশায় হয়তো নদীর পাড়ে কিংবা সুপারিবাগানে হেঁটে বেড়ায়। না হলে, সে ফিরেই দেখতে পাবে কেন, এক বালতি জল আর কাঁসার ঘটিটি সিঁড়িতে রাখা আছে। না হলে ফিরেই দেখবে কেন, তার জামাপ্যান্ট ভাঁজ করা, চকির এক কোনায় সাজিয়ে রাখা, চাঁপা ফুল তুলেও একটা কাচের গেলাসে জলে ডুবিয়ে রাখে। এই ঘরের সব সৌন্দর্য তৈরি হয় তার হাতে। সে যা কিছু এখানে সেখানে ফেলে রাখে, তিথির কাজ তা গুছিয়ে রাখা।
এ জন্য অরুর নিজের উপরও রাগ হয়।
কিন্তু মুশকিল, কমলদা কিংবা বিশুদা ডাকলে তার ছুটে যাবার অভ্যাস—শীতে ব্যাডমিন্টন, বর্ষায় স্কুলের মাঠে ফুটবল, কিংবা স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসে নাটক, এ—ছাড়া কত যে আকর্ষণ, মেজদা ঢাকা থেকে এলে তার সঙ্গে শিকারে যাওয়া, অথবা নদীর চরে ডাল ফেলে রাখা হয়, জোয়ারের জলে ডুবে যায় ডালপালা, ভাটার মুখে জল নামার আগে সব ডালপালা ঘিরে ফেলা হয় বাঁশের বানা দিয়ে। জল নেমে গেলে, সেই ডালপালা সরিয়ে দিলে জলে কাদায় তাজা মাছের ছড়াছড়ি। গলদা চিংড়ি, কালিবাউশ, ভেটকি থেকে কই পুঁটি ট্যাংরা কিছুই বাদ থাকে না। দাদারা পছন্দমতো মাছ ঝুড়িতে তুলে দিতে বলে, জেলেরা মাছের ঝুড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়, সে আর তিথি তার পেছনে পেছনে ছোটে।
তখন তার মনেই থাকে না, সে তিথির জন্য কাজ বাড়িয়ে রেখে যাচ্ছে। বই খাতা সব চকিতে ছড়ানো ছিটানো। কলম পেনসিল, জিওমেট্রি বক্স যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। স্কুল থেকে ছুটে আসে। যেন সে তাড়াতাড়ি বের হতে না পারলে তার মজা উপভোগ করার সময় পার হয়ে যাবে। তিথি আছে, সে—ই সব করবে।
সে—ই সব তুলে রাখে। সাজিয়ে রাখে। জিওমেট্রি বক্স খোলা, বাক্সের সবকিছু এলোমেলো, তিথির কাজই হল, ঠিকঠাক তুলে রেখে দেওয়া। এত যে মজা উপভোগ করতে পারে তিথি আছে বলেই।
তিথি কেমন ভীরু পায়ে লন পার হয়ে এগিয়ে আসছে।
সে বুঝতে পারছে না তার কী দোষ।
অরু সিঁড়ি থেকে নড়ছে না।
তিথি অত্যন্ত ভীরু মুখেই বলল, আমি কী করেছি?
আগে কাছে আয়।
তিথি ভয়ে কাছে যাচ্ছে না।
বলোই না। আমি তো কাছেই আছি।
ঘরে আয়।
না ঘরে ঢুকব না।
ঢুকবি না?
তুমি কি আমাকে মারবে?
তোকে মারতে পারলে ভালো হত। তুই কখন রাতে বাড়ি যাস? সারাদিন বাবুদের বাড়িতে পড়ে থাকতে ভালো লাগে?
তিথি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাতে তুই রোয়াকে বসে থাকিস কেন? তুই কি রাতে বাবুদের বাড়িতে খাস। তোকে কি তারা দু—বেলা খেতে দেয়।
দেবে না কেন? যখন যা বেশি হয় দেয়। সবাই খেলে কিছু তো পড়ে থাকেই। আমি আলাদা থালায় তুলে রাখি। ওতেই পেট ভরে যায়।
সারাদিন ধরে বাবুদের বাড়ির সবার উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বেড়াস? তোর খারাপ লাগে না।
বারে, খারাপ লাগার কী আছে। তুমি কি এজন্য আমাকে ডেকেছ? আমার কত কাজ জানো? তুমি জানো, ছোড়দির আজ পুতুলের বিয়ে। আমি না গেলে সব কাজ পড়ে থাকবে। পুতুলের জামাকাপড় আমি না গেলে পরাবে কে! দেরি হলে রাগ করবে। আমাকে খামচে দেবে। আমার ফ্রকও ছিঁড়ে ফেলতে পারে। ছোড়দির বেজায় রাগ জানো? আমাকে কি বলেছে জানো?
কী বলেছে!
তুমি নাকি ছোড়দিকে দেখলে পালাও।
মিছে কথা।
ছোড়দি মিছে কথা বলে না। ছোড়দি তো কাউকে ভয় পায় না। মিছে কথা বলতে যাবে কেন?
পালাই! বেশ করেছি। বলবি বেশ করেছি।
ছোড়দির সঙ্গে কথা বলো না কেন? তাই তো খেপে যাচ্ছে। তোমাকে দূর থেকে দেখলেই বলবে, দাঁড়া না অরুকে আমি মজা দেখাচ্ছি। ভুঁইঞাকাকাকে বলে এমন মার খাওয়াব না, জীবনেও ভুলতে পারবে না।
তিথি তার সঙ্গে এতদিন নিজের কথাই বলেছে—সে কারও নিন্দামন্দে থাকে না। তুলির কোনও কথাই এতদিন বলেনি। আজ কি তিথি বুঝতে পেরেছে, সে উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়ালে, তার অরুদাকে ছোট করা হয়। অরুদাকে বিশ্বাস করে সে কি তাকে নিজের মানুষ ভেবে ফেলেছে।
তিথি বলল, ঠিক আছে পরে কথা হবে। বলেই ছুট। একদণ্ড আর দাঁড়াল না। বাটিতে মুড়ি আর দুটো সন্দেশ নিয়ে এসে হাজির। ঘরে আলাদা তার কাঁসার গেলাস আছে, কুঁজো থেকে গেলাসে জল ভরে একটা টিপয়ে রেখে বলল, আমি যাচ্ছি অরুদা। দরজা খোলা রেখে উধাও হবে না। শেকল তুলে দিয়ে যাবে। কুকুর বিড়ালের উৎপাত আছে বোঝ না।
তারপর আর তিথি একদণ্ড দাঁড়াল না। বড় বেশি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে, লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়। তিথি দৌড়ে মাঠ পার হয়ে লনের ভেতর ঢুকে গেল। অরু বাইরে দাঁড়িয়েছিল, তিথি একসময় পাঁচিলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তার এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হয়ে যাওয়া দরকার। দেরি হলে বিশুদা, অমল, কমল সবাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শহর থেকে মেজদা নতুন র্যাকেট নিয়ে এসেছে। কর্ক এনেছে এক ডজন। শীতের শেষাশেষি নদীর পাড়ে নেট টাঙিয়ে আজ থেকে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হবে। সে সঙ্গে না থাকলে বাঁশ, খোনতা কে নিয়ে যাবে! সে একজন আমলার পুত্র, এ—কাজটা তারই করা উচিত।
গোলঘরে যাবার সময়ই ভাবল, তিথিকে বড় বড় কথা না বললেই পারত। তিথি খারাপ পেতে পারে। তিথি এভাবে বাবুদের উচ্ছিষ্ট খেয়েই বড় হয়ে উঠেছে। কেন যে মনে হল বাবাও তার উচ্ছিষ্টভোজী এবং সেও। তার মুখে অত বড় বড় কথা শোভা পায় না। তিথি তার কথা শুনে ভাগ্যিস হেসে ফেলেনি।