আর নালিশ, জানো, নিয়ে পালাচ্ছিল। বাতাবি লেবুটা গাছের নীচে কখন পড়ে আছে, আমিও জানো খেয়াল করিনি। শ্রীশ ধরের ব্যাটা নিয়ে পালাচ্ছিল। আমাকে দেখে ফেলে দৌড়োছে।
তিথি ঘরে ঢুকে গেছে ততক্ষণে। সে তাঁর বিছানা মশারি গুটিয়ে কাঠের তাকে তুলে রাখছে। তিথির ডাকাডাকিতে অরু বিছানায় উঠে বসল। নতুন জায়গা—এটা একটা কাছারিবাড়ি কিছুই বোধহয় তার মনে ছিল না। চোখ কচলে হাত পা ঝাড়া দিতেই বুঝল সে তা বাবার কর্মস্থলে—তিথিকে দেখে তার সব মনে পড়ল—রাতের অন্ধকারে কেমন সব কিছু রহস্যাবৃত ছিল, এই সকালবেলায় সে বিছানা ছেড়ে নামার সময়ই, দেখল সামনে সুপারিবাগান, তার ভেতর দিয়ে নদীর পাড়, চড়া, সাদা কাশফুলের ওড়াউড়ি। বাবার স্নান জপতপ সারা। কারণ বাবা একটি ফতুয়া গায়ে দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন আয়নায়। সে কিছুটা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বোঝা যায়। দরজায় দাঁড়াতেই বুঝল, চারপাশে বড় বড় সব আমগাছ, তার ডালপালায় কাছারিবাড়িটা তপোবনের মতো।
তিথি বলল, দাঁড়াও জল এনে দিচ্ছি।
অরুর ভীষণ হিসি পেয়েছে। সে তিথির কথার তোয়াক্কা করছে না। সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে গেলে টের পেল মেলা ঝোপজঙ্গলও আছে কাছারিবাড়ির চারপাশে। তারপর বেশ বড় মাঠ, বাঁশের বেড়া, সেখানে ফুলের সব গাছপালা, সাদা রঙের ছোটখাটো প্রাসাদও চোখে পড়ল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন নদীর পাড় ধরে যতদূর চোখ যায়, সবই বড় সুন্দর করে সাজানো গোছানো।
জগদীশ বের হবার সময় বললেন, তুমি গোলঘরে চলে যাবে অরু। হাত মুখ ধুয়ে নাও। বইখাতা নিয়ে যাবে। অমল কমলের ঘরে পড়বে।
রাতে খেতে বসে সবাইকে সে দেখেছে। অমলদা তার চেয়ে বেশ বড়ই হবে। ক্লাশ নাইনে পড়ে। কমল তার বয়সি কমলদা ঠিক বলা যায় না, সমবয়সিকে সে দাদা বলতে রাজি না। সবাই অবশ্য এখানে বাবু হয়ে আছে। অমলবাবু, কমলবাবু, কারণ জমিদারি যতই সামান্য থাক, ঠাটবাট আছে পুরো মাত্রায়।
খেতে বসেই টের পেয়েছে বাড়িটায় আশ্রিতজনেরও অভাব নেই। লম্বা রান্নাঘরে আসন পেতে সারি সারি পাত পড়েছে। ঝি—চাকরেরও অভাব নেই। একটা ধিঙ্গি মেয়েকে কোলে করে তুলে এনেছে—ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর ফ্যাসাদও সে টের পেয়েছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলে সে বুঝেছিল ইনিই সেই ছোড়দি, গায়ে সাটিনের ফ্রক, ফ্রকের ফাঁক দিয়ে হাতির দাঁতের মতো দুটো লম্বা ঠ্যাং বের হয়ে আছে। মাথায় লাল রিবন বাঁধা, কিছুতেই চোখ খুলছে না—আসনে বসিয়ে দিলেও ঢুলছে। সবাই তাকে খাওয়াবার জন্য যে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবং সে না খেলে বাড়িতে মহামারি শুরু হয়ে যাবে যেন, আহ্লাদ আবদারের শেষ ছিল না।
এই তুলি, কী হচ্ছে! ইস জলের গেলাসটা দিলি তো ফেলে। এ কি রে বাবা, কিছুতেই মুখে দিচ্ছে না।
পাশে যিনি বসে তুলিকে খাওয়াবার চেষ্টা করছেন, তাকে সে চেনে না। পরে অবশ্য তিথি বলেছে, বড়বাবুর সম্পর্কে মাসি হয়—এই বাড়িতেই থাকেন।
তারা যখন খাচ্ছিল—তিথি রোয়াকে বসেছিল, নুন জল লেবু সে পাতে পাতে দিয়েছে। কাঁচালংকা দিয়েছে। পায়ে আলতা পরা বউটিকে বাবার বউঠান, ভাতের টাগারি এগিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশনের জন্য। সারাক্ষণ বউমা বউমা করছেন। এই নাও মাছভাজা। বড় বড় কইমাছ ভাজা পাতে পাতে। ডাল পাতে পাতে। আলু পটলের ডালনা, পাখির মাংস, আর ছোট বাটিতে এক বাটি দুধ সবার। ঘোমটায় ঢাকা মুখ, আর নিষ্প্রভ হারিকেনের আলোতে বউটির মুখ সে দেখতে পায়নি, তবে আলতা পরা পা দু—খানি তার এত সুন্দর, একেবারে দুধে আলতায় যার রঙ সে যে খুবই সুন্দরী তাতে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। সে মাথা নিচু করে বাবার পাশে চুপচাপ খাচ্ছিল, আর তুলির আবদারে বিরক্ত হচ্ছিল।
কী দিয়ে খাবি?
খাব না।
পাখির মাংস দিয়ে খা।
না খাব না।
তবে কী দিয়ে খাবি?
কিছুই খাব না।
দুধ মেখে দিচ্ছি।
দাও।
দু—গ্রাস খেয়েই কেমন ওক তুলে দিচ্ছে।
অরুর বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, মারব থাপ্পড়।
তিথির বয়সিই হবে। সারা বাড়ির মানুষজন, একটা পুঁচকে মেয়ের খাওয়া নিয়ে যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদরে আদরে যে মাথাটি গেছে অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
তিথি রাতে খেয়েছে কি না জানে না।
খেতেও পারে, নাও পারে।
তার বাবা জমিদারবাবুর আশ্রিত। বাড়ির কাজে কিংবা গিন্নিমার ফুটফরমাস খেটে না দিলে যে তাদের সবই যেতে পারে।
তিথি কি সেই আতঙ্কেই থাকে!
পাঁচ
তারপর অরণির এইভাবেই দিন যায়, বছর যায়।
একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে না বলে পারেনি, এই তিথি শোন।
তিথি তার ঘরে জল তুলে দিয়ে গেছে। তারপর সে ছুটছিল বাড়ির অন্দরের দিকে। কাছারিবাড়ির পরে মাঠ, ঘাসের লন এবং দুটো জবাফুলের গাছ পার হয়ে পাঁচিলের দরজায় হয়তো ঢুকে যেত। তার জলখাবার, এই যেমন কখনও তেলমাখা মুড়ি, অথবা চিড়ে ভাজা, সঙ্গে বাদাম ভাজা কিংবা নাড়ু, কখনও ফুলুরি অথবা ফুলকপির সিঙারা, যা তাকে দেয়, সে নিয়ে আসে।
তিথি জবাফুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, ডাকছ কেন?
শুনে যা।
আমার এখন শোনার সময় নেই।
আছে। শুনে যা বলছি।
অরুদা। কোনও কারণে রেগে যেতে পারে, সে ইতস্তত করছিল, গাছের নীচ থেকে নড়ছিল না।
শুনে যা বলছি।
কী যে করো না। কী হয়েছে? কখন সেই সকালে দুটো মুখে দিয়ে গেছ, না খেলে পিত্তি পড়বে না। আমি আসছি।