এই তিথি!
সে অবাক হয়ে তাকাবে।
তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কী খাচ্ছিস?
কী খুশি তিথি! সে তার কোঁচড় খুলে দেখাবে।
যা বাড়িতে, খাওয়া তোর বের করবে।
তিথির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।
জগদীশ জানেন, গোরাচাঁদের ওই এক দোষ। বড় চণ্ড রাগ তার। মাথা গরম হয়ে গেলে সে ভালোমন্দ বোঝে না, মেয়েটার সজল চোখও তাকে আটকাতে পারে না। বড় নির্মম হয়ে ওঠে।
জগদীশের এই হয়েছে মুশকিল। মেয়েটাকে ধরতে পারলেই গোরাচাঁদ টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে আসবে।
তুই মার খেয়ে খেয়ে মরবি! ভুইঞামশাইর ঘরে জল তুলে রাখিসনি! ছাড়া কাপড় কেচে তারে মেলে দিসনি। তোর এত নোলা।
জগদীশ এই সব জানেন বলেই, তিথিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলেন, কোথায় গেল! তারপর নিজেই খুঁজতে বের হয়ে যান। গোরাচাঁদের ভয়, মেয়েটার জন্য তার সব না শেষ হয়ে যায়। বাবুদের অনুগ্রহে জমিদারিতে তার আশ্রয়। একখানা নোটিস ঝুলিয়ে দিলেই তার সব গেল। তিথি তার সর্বনাশ না করে ছাড়বে না।
জগদীশ সুপারিবাগানের এক কোণায় গিয়ে ডাকবেন, গোরাচাঁদ, গোরা আছিস?
আজ্ঞে উনি তো তিথিকে খুঁজতে গেছেন।
যমুনা দরজার বাইরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে বলবে, তিথির গায়ে যেন হাত না তোলে। হাত তুললে খুব খারাপ হবে। আমার মনে হয় মঠের ঘাটে গেছে। পুণ্যস্নান হচ্ছে, মেলা বসেছে, তালপাতার বাঁশি বাজছে, মেয়েটার মন ঘরে টিকবে কেন!
মেলায় নেই।
তা হলে জলে আছে। আমি যাচ্ছি, দেখছি খুঁজে পাই কি না।
আর তখনই তিনি ঠিক দেখতে পান গোরাচাঁদ নদীর পাড় থেকে মেয়েটাকে হাতে ধরে টেনে আনছে। নদীর জলে সারা সকাল যে ডুবে ডুবে পয়সা খুঁজছে, চোখ দেখেই বোঝা যায়। তারপর পাড়ে উঠে নদীর হাওয়ায় ফ্রক শুকিয়েছে, তাও বোঝা যায় শুকনো ফ্রক দেখে, বিন্নির খই, লালবাতাসা কোঁচড়ে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে কিছুটা খেয়েছে, বাকিটা ভাইবোনদের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসার মতলবে ছিল, তাও বোঝা যায় ওর এক হাতে কোঁচড় ধরে রাখার চেষ্টায়। হাত টানাটানিতে না আবার কোঁচড়ের মুঠি ফসকে যায়, যতই গোরাচাঁদ তার মেয়েকে টেনে আনার চেষ্টা করুক না, তিথি তার কোঁচড় ছাড়ছে না।
গোরাচাঁদ জগদীশকে দেখেই থমকে গিয়েছিল। তিথির হাতও ছেড়ে দিয়েছিল।
ভুঁইঞামশায় আমার কী হবে! যমুনা খবর পাঠাল, আপনি তারে কাপড় মেলছেন, তিথি সকালে বেপাত্তা। চরণকে বসিয়ে ছুটে এসেছি। এই দেখুন কী কাণ্ড!
দেখছি। কি রে তিথি কটা পয়সা হল।
তিথির সব ভয়ডর নিমেষে জল।
সে মুচকি হেসে বলল, পাঁচ পয়সা।
এত জল ঘাঁটলে জ্বর হবে যে! বাবার কথা শুনিস না কেন!
তিথি বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুধু তাঁকে দেখছিল।
কোঁচড়ে কী আছে?
খুবই আহ্লাদের গলায় বলল, খই বাতাসা। বলে, কোঁচড় মেলে দেখাল।
যা বাড়ি যা। বাড়ি থেকে গেলে বলে যাবি। তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস বুঝতে পারিস না।
বড় হয়ে যাওয়ার কথায় তিথির কী লজ্জা! সে প্রায় পড়িমরি করে ছুটতে থাকল। কোঁচড় দু—হাতে সামলে, সেই মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটার দিকে ছুটতে থাকলে তার ভাইবোনগুলো বের হয়ে এল প্যাক প্যাক করতে করতে।
গোরাচাঁদ আফসোসের গলায় বলল, বলেন, এই কর্মনাশা মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি! কোথায় যাই।
তিথিকে দেখতে দেখতে জগদীশের পলকে মনে পড়ে যায় সব। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। ছেঁড়া ফ্রকে তাকে খারাপও দেখায় না। মেয়েটার দস্যিপনায় তার বাবা অস্থির। নতুন ফ্রক কিনে দিলে দু—চার মাসও যায় না। ওর বাবাও পেরে ওঠে না। বউঠান, তুলির পুরনো ফ্রক থাকলে মাঝে মাঝে ওকে ডেকে দেন। কী খুশি তখন। ফ্রকটা ছোড়দি গায়ে দিত, সেই ফ্রক সে গায়ে দিচ্ছে। আর যা হয়, তখনই তার কত আবদার সবার কাছে, গাছপালা, জীবজন্তু, পাখপাখালি সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে যেন ফ্রকটা গায়ে দিয়ে ইচ্ছে করলে উড়ে বেড়াতেও পারে।
তখন সর্বত্র তার চোখ।
কে রে? কে সুপারির বাগানে ঢুকেছিস।
সে তেড়ে যায়।
গরিবগুর্বো মানুষেরা এই সব ভূস্বামীদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে যে বেঁচে থাকে জগদীশ ভালোই জানেন। সুপারির খোল বাগানে পড়ে আছে, কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তিথির জ্বালায় তা নিয়ে যাওয়া কঠিন। বাবুদের বাড়ির সবকিছুর উপরই তার যেন হক আছে।
সুপারির খোল নেবে সাধ্য কি!
তার চেঁচামেচির শেষ থাকে না।
অমলদা, দ্যাখো এসে আমাদের সুপারির বাগানে কে এসে ঢুকেছে।
কারও সাড়া না পেলে সে খোল নিয়ে গরিব মানুষটির সঙ্গে টানাটানি শুরু করে দেবে।
এটা আমাদের, তুই মেঘা কোন সাহসে বাগানে ঢুকলি! ভুইঞাকাকাকে দাঁড়া খবর দিচ্ছি।
এই হয়, সুপারির বাগানে হাওয়ায় পাকা সুপারি ঝরে পড়ে। গাছের ডগা থেকে খোল খসে পড়ে। যাওয়া আসার রাস্তায় গরিব মানুষদের চোখ কান শকুনের মতো সজাগ। শব্দ হলেই হল, তাল পড়তে পারে, নারকেল পড়তে পারে, সুপারির খোল পড়তে পারে, এতবড় মহলার মধ্যে কোথায় কী পড়ে থাকে কারও খেয়াল থাকার কথা না, কিন্তু তিথির সব খেয়াল থাকে—বিশাল এলাকায় আম জাম জামরুল গাছেরও অভাব নেই—তিথির মতো কেউ খবর দিতে পারে না, কোন গাছে কী ফল ধরে আছে, কোন গাছে কত আম পেকে আছে। তিথির জ্বালায় গাছের ফল পাকুড় কুড়িয়ে নিয়ে কারও হাওয়া হয়ে যাবার ক্ষমতাই নেই। সে কেড়েকুড়ে সব এনে বউঠানের কাছে জিম্মা দেবে।