নতুন জায়গা, ঘরটার কোনদিকে কী আছে সে কিছুই জানে না। তিথিরা কোনদিকে থাকে তাও না। ঘরে যদি কখনও একা থাকতে হয় তবেই মুশকিল। বাবাকে মাঝে মাঝেই আদায়পত্রে বের হয়ে যেতে হয়। মামলা মোকদ্দমার জন্য শহরে যেতে হয়, তখন এই ঘরটায় কেউ থাকে কিনা সে জানে না। না ঘরটা খালি পড়ে থাকে!
অরণি এসব ভেবে খুব কাতর হয়ে পড়ছিল।
বাবা।
বল।
তুমি না থাকলে রাতে ঘরে কে শোয়?
ঠিক নেই। যার যখন সুবিধা সেই থাকে। রাতে ঘর পাহারা দেবার জন্য মাঝে মাঝে তিথিও এসে শোয়। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।
না তা বলছি না।
দরকারে ওর বাবাও থাকে। হরমোহনও থাকে।
হরমোহন কে বাবা?
বাবুদের পেয়াদা।
ওকে দেখছি না!
আছে। সকাল হোক। সব বুঝতে পারবে, কখন রান্না বাড়ি থেকে তিথি আসে দ্যাখ। তাড়াতাড়ি তোমার শুয়ে পড়া দরকার।
তিথিও শোয়। সে একা শোয়, না আর কেউ সঙ্গে থাকে। তিথি সম্পর্কে সে কোনও প্রশ্ন করতে চায় না। সে যে বড় হয়ে যাচ্ছে বাবা কি টের পান না! বড় হয়ে গেলে তার তো একাই এ ঘরে শোওয়া উচিত। সে থাকলে, অন্য কেউ শুতে আসবেই বা কেন!
তিথি সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করতেই তার সংকোচ হচ্ছিল।
তখনই তিথি বলল, দেরি হবে। এই নাও, ধরো। জল থাকল। সেজদা শিকারে গেছিলেন। বড় বড় দুটো বালিহাঁস শিকার করে এনেছেন। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে।
রেকাবিতে ফুলকো লুচি এবং সন্দেশ। আলাদা রেকাবিতে ভাগ করে তিথি বলল, গিন্নিমা অরুদাকে দেখতে চেয়েছে। খেতে তোমাদের দশটা। এখন এই খেয়ে নিতে বলেছে। তুমি খাও অরুদা। পরে এসে নিয়ে যাব। এত বড় হাঁস। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে!
জগদীশ জানে, মেয়েটার বড় উৎসাহ, সারাক্ষণ পাখি ছাড়ানো দেখবে। বউঠান বঁটি নিয়ে বসলে সে থালাবাসন এগিয়ে দেবে। রান্না বাড়িতে জল বাটনা দেবার লোক থাকলেও গিন্নিমা রান্না নিজের হাতে করেন। বামুনঠাকুর পোষার মতো ক্ষমতা কখনোই ছিল না, মাত্র এক আনার শরিক তা আবার দু—তরফের মধ্যে ভাগ। জমিদারির আয়ও কমে গেছে। আদায়পত্র আগের মতো নেই। তিথি বড় বিশ্বাসী বউঠানের। যতক্ষণ বাড়ির খাওয়া চলবে, কিংবা বউঠানের রান্নার সময় সে ছুটে ছুটে ফুটফরমাস খাটবে। তারপর বউঠান যখন বলবেন, তিথি তুইও আমাদের সঙ্গে বসে যা। খেয়ে নে। তিথির কী আনন্দ তখন।
তিনি এই আশায় আশায় সারাদিন বুঝি ছুটে বেড়ায়। সারাদিন কাজ করার উৎসাহ পায়।
মেজদার সব কথাই অরু জানে। ভালো শিকারি, তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়, ঢাকা শহরে ওয়ারি টিমে হাফ ব্যাকে খেলে। বাবুদের খবর বাড়িতে বসেই সে জেনেছে। যে ক’দিন বাড়ি থাকবেন বাবা, দেবকুমার বাবুর পুত্রদের প্রশংসা। সব সোনার টুকরো ছেলে বাবার ভাষায়। ভুইঞা কাকা বলতে অজ্ঞান। বড় দেখতে ইচ্ছে হত মেজদাকে। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বড়দি মরেও গেছে। আর আছে ছোড়দি। সে নাকি অরুরই বয়সি। পরীর মতো দেখতে। সারা বাড়িতে সুঘ্রাণ। রোয়াক ধরে হেঁটে গেলে এক এক ঘরের খাট পালঙ্ক দেখলেই নাকি ভিরমি খেতে হয়। বৈঠকখানায় সব বড় বড় মানুষ সমান ছবি। পেল্লাই সব দরজা জানালা। হরিণের শিং, বাঘের ছাল দেয়ালে, সে সবই বাবার মুখে শুনেছে।
তিথি বলল, কী অরুদা যাবে? হাঁসটার পেটে ডিম ছিল জানো!
পাখির মাংস খুব সুস্বাদু। আজ সেই পাখির মাংস হচ্ছে বাড়িতে। তার খুবই খেতে ইচ্ছে করছিল, তবে তিথির সব আগ বাড়িয়ে বলার স্বভাবের জন্যই যেন বলল, তুই যা। আমি পরে যাব।
পরে আর যাবে কখন? ততক্ষণে মাংস রান্না হয়ে যাবে।
আসলে তিথি চায়, অরু তার সঙ্গে সেই রান্নাবাড়িতে যেন যায়।
কারণ, একটা বালিহাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা বেঁচে আছে। গুলি লেগে হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে। ধরতে গেলে ঠুকরে দিচ্ছে। মেজদাকে ক্লাবের লোক এসে বৈঠকখানায় ডেকে নিয়ে গেছে। কীসব কথাবার্তা হচ্ছে সে জানে না। ওরা চলে না গেলে পড়ে থাকা হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়ানো হচ্ছে না। মেজদা বড় নিষ্ঠুর এই সব কাজে। তখন বাড়ির কেউ বড় একটা কাছে ঘেঁষে না।
মেজদারই বড্ড শিকারের নেশা।
মেজদার উৎসাহে মাঝে মাঝে পাখি শিকার করে আনা হয়।
ক্লাবের ছেলেরা চলে গেলেই মেজদা আবার রান্নাবাড়িতে ঢুকে যাবে। জখমি হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়িয়ে দেবে। গিন্নিমার কাজ বঁটি নিয়ে বসা। তার কাজ গিন্নিমাকে সাহায্য করা। সে যে এই বাড়ির লোকজনের কাছে কত প্রিয় অরু তার সঙ্গে গেলে টের পেত।
জগদীশই বলল, যা না। বসে থেকে কী করবি। আমি যাচ্ছি। বউঠান তোকে দেখতে চেয়েছে।
অরু যাও যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বাবার কথায় তার উৎসাহে যেন জল ঢেলে দিল। বউঠান তাকে দেখতে চেয়েছেন, সেই বউঠানের সামনে সে নিজে গিয়ে একা হাজির হয় কী করে! বাবা না গেলে তার পক্ষে কোনওভাবেই যাওয়া সম্ভব না। তিথির সঙ্গে তো নয়ই।
এই চলো না অরুদা। এক দৌড়ে চলে যাব। বলে তিথি অরুর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।
ইস কী যে করে না!
কী করেছি তোমাকে! গেলে দেখতে পেতে, কত বড় বালিহাঁস! সেজন্যই তো যেতে বলছি।
কেন যে তাকে হাঁসটাকে দেখানোর এত আগ্রহ তিথির, বুঝতে পারছে না। একটা হাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়ে গেছে, আর একটার ছাড়ানো হয়নি, এখনও পড়ে আছে, আহত হাঁসটাকে দেখাতে না পারলে তিথির যেন নিস্তার নেই। বাবা বাইরে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেছেন খড়ম পায়ে। গামছায় শরীর মুখ মুছে বোধ হয় আহ্নিকে বসবেন। বাবা যে সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে বসে আহ্নিক সারেন, সকালেও বাবার নদীর জলে প্রাতঃস্নান এবং আহ্নিক সেরে কাছারি বাড়িতে ফিরে আসার স্বভাব সে ভালোই জানে। বাবা বাড়ি গেলে, তার নৈমিত্তিক কাজের বহর সম্পর্কে মাকে বিশদ বর্ণনা দিতে ভালোবাসেন, রাত হয়ে গেছে বলে, হয়তো ঘরেই জপতপ সেরে নেবেন, কিংবা যদি মঠে যান, তাও নদীর পাড়ে। বাবা যে কী করবেন সে বুঝতে পারছে না। আবার যদি তাকে একা ফেলে জপতপের অছিলাতে বাবা বের হয়ে যান তবেই মুশকিল। তখন তিথি সহজেই তাকে কবজা করে ফেলতে পারে।