জগদীশ প্রায় দৌড়েই দরজার দিকে ছুটে গেলেন। অরুকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি। ঝড় শিলাবৃষ্টি, আকাশ মেঘলা ছিল ঠিক, তবে এতটা ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে বুঝতে পারেননি। দরজায় এসে ডাকলেন, অরু দরজা খোল। আমরা ভিজে যাচ্ছি।
অরুর কেমন কিছুটা বাহ্যজ্ঞান লোপ হয়ে গেছিল। সে আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। দরজা খুলে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ায় তার শরীর কিছুটা যেন তাজা হয়ে গেল। তিথিকে দেখে আবার সাহস পেল বোধ হয়। এতটুকুন মেয়ে প্রায় তারই বয়সি, বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে তাকে দেখবে বলে চলে এসেছে।
সে কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেল।
জগদীশ বললেন, তোর কী হয়েছিল?
কিছু না তো।
তবে তিথিকে দরজা খুলে দিসনি কেন। হাতমুখ ধুয়েছিস?
অরু বলল, না।
তিথি বলল, বালতিটা কোথায়?
তিথি বালতি খুঁজতে দরজা ঠেলে পাশের ঘরটায় ঢুকে গেলে জগদীশ বললেন, ওখানে পাবি না, চকির নীচে আছে দ্যাখ।
হেমন্তে যে মাঝে মাঝে এ সময়ে শিলাবৃষ্টি হয় অরু জানে। ঝড়বৃষ্টি দুপদাপ করে এল, দুপদাপ করে আবার চলেও গেল। তিথি বালতি হাতে বের হয়ে গেল, কল থেকে জল টিপে সিঁড়িতে তুলে রাখল। কাঁসারবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও বাইরে। কাকা তুমি আমাকে টর্চটা দাও তো। দরজায় হারিকেন নেওয়া যাবে না, নিভে যাবে। অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, বসে থাকলে কেন? হাতমুখ ধুয়ে নাও। খাবে না। সেই কোন সকালে বের হয়েছ!
জগদীশ জানেন, তিথির কথাবার্তায় বেশ পাকামি আছে। তিথি সবাইকে বড় বেশি নিজের ভাবে। কাছারি বাড়ির এক কোণায় মাঠের ঝুপড়িতে থাকে। তিনিই বাবুদের বলে কাঠা দু’এক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে ঝুপড়ি বানিয়ে বছর দশেক হল গৌর ওরফে গোরাচাঁদ উঠে এসেছে। বছরখানেকের বয়স ছিল তখন মেয়েটার। কত তাড়াতাড়ি যে বড় হয়ে গেল।
তিথিকে কিছু বলতে হয় না।
যেমন জগদীশের জামাকাপড় কেচে রাখা, জল তোলা এবং বিছানা করার কাজটিও সে করে দিয়ে যায়। জগদীশ এসব পছন্দ করেন না। তবে তিথি তাকে পাত্তাই দিতে চায় না। সে তার মতো কাজ খুঁজে নেয়—শুধু তারই নয়, বড় তরফের ছোট তরফের সবার হেঁসেলেই তার অবাধ যাতায়াত।
তিথি হামাগুড়ি দিয়ে দড়ি থেকে গামছা তুলে এনে অরণির হাতে দিল।
অরুর ইচ্ছে নয়, মেয়েটা এভাবে তার উপর মাতব্বরি করুক। কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, রাখো, আমি নিজেই নিতে পারব।
নিজে নিতে পারবে তো, চুপ করে বসে আছো কেন? কাকাকে জ্বালাতে বুঝি খুব ভালো লাগে! কখন থেকে বলছে, হাতমুখ ধুয়ে নে অরু, জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেল, তোমার কোনও গেরাহ্যি আছে।
অরু বুঝে পেল না, মেয়েটাকে কে এত আশকারা দেয়। সে তাকে চেনেই না, বাবাও তিথির কথা কিছু বলেনি, কিন্তু যেভাবে তার পেছনে লেগেছে, শেষে না জানি কী হয়! তারও রাগ কম না। আর কোথা থেকে উদয়! বাবাকে পর্যন্ত সমীহ করে না। তাঁর সামনেই তাকে হেনস্থা করতে চাইছে।
সে এখানে যতটা জলে পড়ে যাবে ভেবেছিল, তিথিকে দেখে সহসা কেন জানি মনে হল, না তাকে বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হবে না। তিথি বড়ই সতর্ক তার ভালো মন্দ নিয়ে। সে কিছুটা নরম হয়ে গেল। বলল, কোথায় থাকিসরে তুই?
কোথায় থাকি, সে দিয়ে কি হবে? দয়া করে তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি দেখছি বড়গিন্নি কী করছে। তোমাদের খাওয়ার কতদূর। তারপরই বলল, এই নাও পাউটি। খালি পায়ে হাঁটবে না বলে দিলাম।
তিথি দরজা দিয়ে মাঠের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কোথা থেকে একজোড়া পাউটি বার করে রেখে গেল তার জন্য।
তিথি থাকায় তার জামাপ্যান্ট ছাড়তে লজ্জা হচ্ছিল। কখন আবার উঠে আসবে, কে জানে। সে সিঁড়িতে হাত পা ধুয়ে কাঠের পাউটি পরে ঘরে ঢুকে গেল। ভিজা গামছা দিয়ে গা মুছল, টিনের স্যুটকেস থেকে হাফপ্যান্ট হাফশার্ট বের করে নিল। ছাড়া প্যান্ট সার্ট চকিতে রাখলে জগদীশ বললেন, নিচে ফেলে রাখ। চকিতে রাখলে মেয়েটা চোপা করতে পারে।
বাবা দেখছি মেয়েটার কাছে জব্দ। এমন একটা পুচকে মেয়ের কাছে বাবার এত জব্দ থাকার কী কারণ সে বুঝল না। মনিবের মেয়েও নয়, মনিবের বাড়িতে আশ্রিতই বলা চলে। চকির উপর ছাড়া কাপড় রাখলে মেয়েটা ক্ষুব্ধ হতে পারে। এতটাই জব্দ যে সে জামাপ্যান্ট চকির একপাশে রেখে দিলেও বাবা তা নিয়ে ঘরের এক কোণায় রেখে দিলেন। সে কিছু আর বলতে পারল না। দেয়াল ঘড়িতে আটটা বাজে। তার খিদেও পেয়েছে—সারাদিনে সেই বাবা লোকনাথের আশ্রমে সামান্য বাল্যভোগ ছাড়া পেটে ভাত পড়েনি। ভাত না খেলে সে শরীরে জোর পায় না। তার তিনবেলা ভাত চাই।
সেই অরু বসে আছে, কখন তিথি খবর নিয়ে আসবে। কখন খেতে ডাকবে।
বাবা আয়না চিরুনি তাক থেকে নামিয়ে বললেন, মাথা আঁচড়ে নাও।
এখন দরজাও খোলা।
ঠান্ডা হাওয়ায় অরুর শীত শীত করছে। যেন গায়ে একটা চাদর জড়ালে ভালো লাগত।
সে একসময় না বলে পারল না, চালে ঘসটানো শব্দ হচ্ছিল খুব।
ও হয়। হাওয়া উঠলে হয়। আমগাছের একটা ডাল চালে এসে পড়েছে। হাওয়ায় নড়ে।
টিনের চালের এই দোষ। বৃষ্টি হলে ঝম ঝম শব্দ হয়। আবার শকুন উড়ে এসে বসলেও টের পাওয়া যায়। এমনকি কাক শালিখ চালে এসে উড়ে বসলেও কীরকম মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। টালির চাল থাকলে এতটা হয় না। খড়ের চাল থাকলে একদম কিছুই টের পাওয়া যায় না। অরু বাড়ির বৈঠকখানায় থাকে। খড়ের চাল—চৌচালা ঘরটা ঠান্ডা রাখার জন্য খড় দিয়ে ছাওয়া।