তার গলা শুকিয়ে উঠছে।
বাবা কতদূরে গেল!
তক্তপোশে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে উঠে গেল। উঁকি দিল—না শুধু নিশীথের জোনাকি ছাড়া আর কিছুই গোচরে আসছে না।
সে ভেবেছিল, জমিদার বাড়ির সংলগ্ন কোনও গৃহে বাবা থাকেন। বাবা দেশে গেলে নিজের থাকা—খাওয়া নিয়ে মাকে মাঝে মাঝে যেসব খবর দিতেন, তাতে সে বুঝতেই পারেনি, বাবাকে এমন একটা পরিত্যক্ত আবাসে থাকতে হয়। বাবা একা ঘরটায় থাকেন, তবে দু—একজন পাইক কি লেঠেল জমিদারদের থাকবে না, হয় কী করে! এ যে একেবারে ন্যাড়া! কাঠের কড়ি বরগার উপর মুলিবাঁশের আচ্ছাদন, এখানে সেখানে ঝুলকালি, কাঠের একটি তাক এবং সেখানে তোষক বালিশ মাদুর—কোনও মৃত মানুষের মুখও তার চোখে যেন ভেসে উঠল। এই বাড়িতে কোনও এক অপমৃত্যুর দিনে বাবা রাতে টের পেয়েছিলেন, টিনের চালের উপর কারা সব নৃত্য করছে। কারণ সে রাতে টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ, ঠিক ঝড়বৃষ্টিতে টিনের চালে যেমন শব্দ হয়ে থাকে, বাবা কোনও অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে দিশেহারা যে হয়ে গেছিলেন, তাও সে জানে। বাবা আতঙ্কে সে রাতে ঘুমোতে পারেননি।
সকালে উঠেই ছুটে গিয়েছিলেন জমিদার বাড়ির অন্দর মহলে। রাতে যে তাঁর টিনের চালে অশুভ আত্মারা নৃত্য করে গেছে তারও খবর দিলেন। কেমন অমঙ্গলের আভাস পেয়ে দেবকুমারবাবু গুম মেরে গেছিলেন। বিন্দুমাত্র বৃষ্টি না, শিলাবৃষ্টিও না—শকুন উড়ে এসে বসলেই এমন শব্দ হয়ে থাকে—তারপর বাবাকে ইঙ্গিতে বসতে বলেছিলেন।
তুমি ঠিক শুনেছ, টিনের চালে দাপাদাপি হচ্ছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বের হয়ে দেখলে না কেন?
আজ্ঞে….
মনে হয় রাতে চালে শকুনের পাল উড়ে এসে বসেছিল। ঠিক আছে, আর কাউকে বলতে যাবে না। এতে গোটা বাড়িটাই ত্রাসে পড়ে যেতে পারে। শনি সত্যনারায়ণের পূজার ব্যবস্থা করো। শান্তি স্বস্ত্যয়ন করা দরকার। কিছুই ভালো বুঝছি না। বাড়িতে কেউ কেউ এভাবে অমঙ্গলের আভাস দিয়ে যায়।
বাবার মুখেই শোনা, বাবুর বড় কন্যাটির মৃত্যুর খবর এসেছিল তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়। কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এই পরিবারের এই সব দুর্ঘটনার খবর আগাম কে যে জানিয়ে যায়। ঘরের চালে শকুন উড়ে এসে বসলে এমনিতেই খারাপ লাগে, ভয়েরও কথা, আতঙ্কও কম থাকে না। দিনের বেলাতেই একবার একপাল শকুন উড়ে এসে তাদের কাঁঠাল গাছের মাথায় বসে পড়েছিল—সারা গাঁয়ে হইচই—লোকজন ছুটে এসে গাছের মাথা থেকে শকুন তাড়ানোর দৃশ্যটির কথা তার মনে পড়ছে। শকুন ওড়ে, গাছের মগডালে বসেও থাকে, তবে সবই পরিত্যক্ত এলাকায়, যেমন সিংগিদের পুকুর পাড়ের জংলায় যে বটগাছটা কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তার মগডালে সে শকুন বসে থাকতে দেখেছে। প্রভাকরদির বাজারে যাবার রাস্তায় প্রায় একটি জনশূন্য প্রান্তরের গাছটিতে শকুনের বাসা আছে। তবে রাতে সে রাস্তায় কেউ যায় না। বাজার থেকে কেউ ফেরেও না সেই রাস্তায়।
সে ভেতরে ভেতরে ভয়ে যে গুটিয়ে যাচ্ছে টের পেতেই তার মুখ চুন হয়ে গেল।
দরজা খোলা।
সে কোনোরকমে প্রায় টলতে টলতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
ঠিক তখনই তক্তপোশের নিচে সরসর শব্দ।
ঠিক তখনই টিনের চালে কীসের যেন ঘষ্টানোর শব্দ।
তারপর শো শো আওয়াজ।
জানালাটার কাঠ দুটো ঝোড়ো হাওয়ায় ফসকে গিয়ে পাল্লা দুটো দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার খুলেও গেল।
হারিকেনের আলো দপ দপ করে জ্বলছে।
সে ঘামছিল।
হারিকেনটা দুলছে।
কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক খণ্ড বিখণ্ড উপদ্রবে সে যে পড়ে যাচ্ছে, সে ঘোলা ঘোলা দেখছে সবকিছু, বাবা তাকে ফেলে এভাবে কোথায় চলে গেলেন—সে যেন মূর্ছা যাবে।
আর তখনই জানালায় এক সুন্দর বালিকার মুখ। বড় বড় ফোঁটায় বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। বালিকার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে। জানালার গরাদ ধরে কিছুটা উপরে উঠে ডাকছে। এই অরুদা, তোমরা কখন এলে!
সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় এতটুকুন একটা মেয়ে একা আসতেই পারে না। ফ্রক গায়, দু বিনুনি চুলে, বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, একবারও বলছে না, দরজা খুলে দাও। কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে বলছে অরুদা, তোমার ভয় করছে না তো। আমি জানি, একা তুমি ভয় পাবে। থাকতে পারলাম না। সারাদিন নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি, কখন তুমি আসবে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কিছু যে মনে হয়। আমিতো জানি, স্টিমার সাঁজবেলায় আসে কিন্তু কী যে হয়, সকাল দুপুর যখনই সময় পেয়েছি ছুটে গেছি নদীর পাড়ে। অরুদা আসবে। কাকা যে বলে গেছে, আজ তোমাকে নিয়ে কাকা ফিরবে। তুমি ভয় পাচ্ছো না তো! নতুন জায়গা, ভালো নাই লাগতে পারে। দরজাটা খোলো না। এই কী কথা বলছ না কেন? চোখ গোল করে আমাকে এত দেখছ কেন! আমি বাঘ না ভালুক। দেখছ না বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি, দরজা খুলে দিতে পারছ না!
মেয়েটা ফের বলল, আমার নাম তিথি। ভুইঞা কাকা আমাকে নটসুন্দরী বলে ডাকে। বাজারে আমার বাবা জিলিপি ভাজে। তুমি দরজাটা খুলে দাও না। কেবল আমাকে হাঁ করে দেখছ!
তখনই দূরে টর্চবাতির আলো জ্বলে উঠল।
আর তিথি লাফিয়ে নেমে গেল অন্ধকারে।
কে রে ছুটে পালাচ্ছিস!
তিথি বলল, আমি ছুটে পালাইনি। তাড়াতাড়ি এসো। অরুদা না, আমাকে দেখতে দেখতে কেমন হিম হয়ে গেছে।