ঘাটোয়ারিবাবুর কথা শুনে হরীতকীর চোখ দুটো ভার হয়ে উঠল। ওঁর বসার জন্যে পিঁড়ি বের করল, পেতে দিল। তিনি বসলেন। হরীতকী বলল, কী আর করব বাবু। ঘাটে কাঠ দিতে গিয়ে গিল রাতে বেটি হামার হয়ে গেল। তারপর কী ভেবে হরীতকী, বাবুর সামনে ওকে শুইয়ে দিল। কুঁকড়ে আছে বাচ্চাটা। রোদের উত্তাপে আর কাঁদছে না। চোখ দুটো ঠিক মেলতে পারছে না। বুড়ো বয়সের এই বাচ্চা হরীতকীর খুব দরদের। হরীতকী খুব খুশি হয়েছে। হরীতকী অপলক চেয়ে থাকল।
ষাটোয়ারিবাবু ভাবলেন চতুরা বেঁচে থাকলে দু হাঁড়ি পচাই গিলত আজ। খুশিতে ডগমগ করত। হরীতকীর দিকে চেয়ে বললেন, কাল কাঠ না বইলেই পারতিস। চিতা না সাজালেই হত। তারপর তিনি ফিসফিস করে বললেন, যাক সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এবার তাহলে তুই সং সাজলি হরীতকী! তিনি এই বলে উঠে পড়লেন।
হরীতকী ডাকল—বাবু—
কিছু বলবি আমাকে?
হরীতকীর চোখ দুটো লজ্জায় ভারী হয়ে উঠছে। তবু সে না বলে যেন থাকতে পারল না—বাবু বাচ্চাটা কেমন দেখলি?
ঘাটোয়ারিবাবু নিস্পৃহ জবাব দিলেন—ভালো।
কার মতো হবে বুলত?
তোর মতো।
না তোর মতো হবে দেখে লিস। হরীতকী ঘাটোয়ারিবাবুর দিকে চেয়ে হাসল। তিনি কিন্তু হাসলেন না। তিনি হরীতকীর মুখ দেখলেন। চোখ, মুখ, শরীর, দেখলেন হরীতকীর। চোখে এক ধরনের ইচ্ছার প্রকাশ—যা ঘাটোয়ারিবাবুকে কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেন বলতে চাইছে—আ যা বাবু কাঁহা ভি চল যাই। যেন বলতে চায়—এ—চটান ছোড় দে।
তিনি মুখের ভাবটুকু উদাস করতে চাইলেন। অথবা কেমন অসহায় মনে হল ঘাটোয়ারিবাবুকে। তিনি বললেন, আমার মতো হলে তুই খুশি হবি, কিন্তু লোকে তা হবে না। চতুরার মতো হলেও ভালো হয়। লোকে চতুরার ছা বলেই জানুক। চতুরার মতোই ও দেখতে হোক। সংসারের সং সাজতে আমার আর ইচ্ছে নেই।
হরীতকীর চোখেমুখে গরল উঠতে চাইল!—সংসারের সং সাজতে তুকে বুলেছি! আর বুলব না। পেটটাকে লিয়ে এতদিন ভয় ছিল। পেটটা খালাস হয়ে হামাকে খালাস দিল। হামাকে লিয়ে তোকে আর কোথাও যেতে হোবে না। কোথাও আর পালাতে বুলব না। হামার নসিব লিয়ে হামি বেটি কে সাথ এ—চটানেই পড়ে থাকবে। লেকিন তুকে বুলবে না—আ যা বাবু—কাঁহা ভি চল যাই। কভি বুলবে না এ—চটান ছোড় দে।
যে রোদটা অশ্বত্থ গাছের ডাল ধরে নিচে নেমেছিল সেই রোদ এখন অশ্বত্থ গাছের ডাল বেয়ে উপরে উঠছে। ঝাড়ো ডোম দাওয়ায় বসে তামাক টানছে। হরীতকী বাচ্চা দিয়েছে বলে ঝাড়ো ডোমের ঘর থেকে ঘাটোয়ারিবাবুর খাবার গেছে। অফিসঘরের কোনায় টিনের থালায় কিছু ভাত, ডাল, শাকসবজি। ঘাটোয়ারিবাবু কিছুক্ষণ গীতা পাঠ করেন এই সময়, জানালায় বসে কিছু সময় মা গঙ্গা দর্শন করেন। তারপর তিনি কিছু আহার করেন। এই সময় ডোমেদের ছোট ছোট ছেলেরা অফিসঘরটার চারপাশে ঘুর ঘুর করবে—কখন তিনি ডাকবেন সেই আশায় অপেক্ষা করবে—যেদিন ডাকবেন না জানালা দিয়ে ওরা উঁকি মারবে অথবা হাত পাতবে। তিনি বলবেন—এখন হবে না। যা।
কৈলাস ওর ঘরে শুয়ে আছে। মাচানে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর শেষ পক্ষের বৌ ঠান্ডাভাত খাচ্ছে। সঙ্গে দুটো কাঁচা পেঁয়াজ নিয়েছে, দুটো কাঁচা লংকা নিয়েছে। পিঠে রোদ দিয়ে খাচ্ছে। সে পিঠ চুলকাল। চোখ কোঁচকাল। কাঁচা লংকার জন্য জল পড়ছে চোখ থেকে। নেলি ঘরের ভিতর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব দেখছে। সেও শুয়ে আছে মাচানে। শরীরে কাঁথা—কাপড় টেনে উপুড় হয়ে দুটো হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর সৎমার খাওয়া দেখছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা যমুনাও নেলির মতো চোখ মুখ নিয়ে বসে আছে। নেলির কষ্ট হতে থাকল। নিজে খেতে পারল না, গঙ্গা যমুনাকে খেতে দিতে পারল না। এ সময় ঘাটোয়ারিবাবু খেতে বসবেন। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং ধীরে ধীরে অফিসঘরের দিকে হাঁটতে থাকল। জানলার পাশে এবং সিঁড়ির ওপর সে দেখল লখি, টুনুয়ার ছোট দুটো ভাই ঝাড়ো ডোমের ছোট দুটো বেটি বসে আছে। নেলিও ওদের পাশে বসল। গঙ্গা যমুনাও বসল। সিঁড়ির ওপর বসে ওরা সকলে খাওয়ার গল্প করল।
আজ কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু কাউকে ডেকে ভাতের দলা দিলেন না। তিনি নিজেই সবটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিলেন। ঝাড়োর বৌ ভাত যতটা পেরেছে কম দিয়েছে। জল খাওয়ার সময় তিনি হাসলেন। ভাবলেন, পেটে কিল মেরে কথা বের করে শুনেছি, কিন্তু ঝাড়োর বৌ যে দেখছি পেটে কিল মেরে ভাত বের করবে। ঘরের ভিতর কুলকুচা করার সময় তিনি বললেন, তোরা যা। দাঁড়িয়ে থাকিস না। আজ আমারই পেট ভরল না। তোরা যা। অথচ তিনি জল খেয়ে ঢেকুর তোলার চেষ্টা করলেন।
নেলি ভাবছে ফের গঙ্গায় গিয়ে নামে। ফের সেই হাতের গলার গহনা দেখে! মংলির চোখটা গঙ্গা যমুনাকে দিয়ে উপড়ে আনে। কিংবা ইচ্ছা হচ্ছে হাতের গলার গহনা আগুনে কেমন গলছে সেই দেখার। সোনা গলে গলে যেন ছাই হয়ে যায়। কিন্তু ছাই হবে না ভেবেই ওর যত দুঃখ এখন। সেজন্য গঙ্গায় নামতে পর্যন্ত ইচ্ছা হল না। রাগে দুঃখে, ভয়ে এবং পেটের যন্ত্রণায় দুটো চোখ ক্রমশ বসে যাচ্ছে। ক্রমশ নেলি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শরীরটা নিয়ে আর চটানে ঘুরতে ফিরতে পারছে না। নেলি সেজন্য মাচানেই ফিরে এল। মাচানে শুয়ে শুয়ে বাপের জন্যে অপেক্ষা করবে। বাপ যদি ধারদেনা করে কিছু চাল ডাল নিয়ে আসে, যদি বাপ রাতের মতো কিছু ব্যবস্থা করে ফেরে এই ভেবে দুর্বল শরীর নিয়ে কোনোরকমে মাচানের কাছে এল। মালসায় কিছু জল ঢালল এবং ঢকঢক করে এক মালসা জল খেল। তারপর মাচানে উঠে বালিশ টেনে কাঁথা—কাপড়ের ভিতর শরীর গলিয়ে দিল। কাঁথার নিচে নেলি এখন কিছু যেন ভাবছে অথবা যেন ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।