ঘাটোয়ারিবাবু জানালার পাশে দাঁড়ালেন। জানালা ধরে অন্ধকার গলে গলে পড়ছে। গেরু পাশে চুপচাপ অপরাধীর মতো বসে আছে। বাবুর ইচ্ছা হচ্ছে না গেরুর চোখে—মুখে ডিম পাড়ার আনন্দ চিহ্ন থাকুক। ইচ্ছা হচ্ছে না চটানে গেরু বাপ হোক। তিনি বিদ্রূপ করে বললেন, তাহলে তুইও বাপ হলিরে গেরু!
বাবুর কথা শুনে গেরু লজ্জা পেল। সে কোনোরকমে বলে, জী বাবু হামি বাপ হবে।—বাবু তিন দিন হোবে মানুষটা মরল।
ঘাটোয়ারিবাবু নিমা বাগদীকে চেনেন। নিমা বাগদীর দল আছে একটা। ওরা দেশ—দেশান্তরের মড়া পুড়িয়ে বেড়ায়। মড়াকে গঙ্গা পাইয়ে দেয়। দূর দূর গাঁয়ের মড়া নিয়ে সে ঘাটে আসে! দূর থেকে এলে মড়াগুলো ফুলে—ফেঁপে ওঠে। কৈলাস থাকলে সে ব্যবস্থা করত ওদের। পোড়ানোর কাঠ লাগত না। ওদের কাঠের পয়সা বাঁচত, ঘাটবাবুর কাঠ বাঁচত। কৈলাসের থাকত কঙ্কালটা। কৈলাস কঙ্কালের পয়সার ভাগ দিত বাবুকে। নিমা বাগদীর অনেকদিন দেখা নেই। তিনি ভেবেছিলেন নিমা বুঝি মরেছে।
গেরু বাপের মতো শরীর টেনে বলল, বাবু আপনার ভি কুছু হোবে। হামার ভি কুছু হোবে।
ঘাটোয়ারিবাবু কী ভেবে একবার গেরুর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তা হয় না। দশমাসের আগের মানুষটা আমার বেঁচে নেই। মানুষটাকে পোড়ানো হবে না, সে টাকায় ওরা মদ খাবে। আমার কাঠ বাঁচাবে, দু পয়সা হবে? এসব আমার ভালো লাগে না। ঘাটোয়ারিবাবু ফের চেয়ার টেনে নেন। জানালায় ঝুঁকে পড়েন। কী ভেবে গেরুকে কাছে ডেকে বলেন, তুই যা। মড়াটা পাবি না। মরা মানুষকে ঠকাতে আমার ভয় করছে গেরু।
গেরুকে উঠতে না দেখে তিনি ফের প্রশ্ন করেন, বাচ্চাটার কী নাম রাখবি?
বাচ্চাটা না হতে বিবিটা যে মরে যাবে গ।
ঘাটোয়ারিবাবু যেন সব ভুলে গেছেন এমন ভাব দেখিয়ে বলেন, কেন, কেন? কেন মরবে বিবিটা?
ভুখা থেকে। সে বাত ত বুলছি বাবু।
এ সময় ঘাটোয়ারিবাবুর ইচ্ছা হল বিবিটা ওর মরুক। চটানের সব মরুক। মরে মরে সব সাফ হয়ে যাক। এত মড়া দেখেছেন, আর একটা মড়া দেখতে ক্ষতি কি। তিনি এবারেও বলেন, তুই যেতে পারিস গেরু। মড়া আমি তোকে দিতে পারব না। সারাজীবন তাজা মানুষকে ঠকিয়ে ঠকিয়ে এখন মরা মানুষকে ঠকাতে ভয় করছে।
গেরু শেষবারের মতো চেষ্টা করল, বাবু একটা মরা মানুষ পেলে দুটো জেতা মানুষ বাঁচে।
তুই আর তোর বিবির কথা বলছিস?
জী না। বিবি—বাচ্চাটার কথা বুলছি। বাবু হামার বাচ্চা হবে, ওয়ারে মেরে লিবেন না! হামার বাচ্চা—বড় সাধের, বড় শখের। থোড়া মেহেরবানি করেন। আপ মা—বাপ আছে। গেরু ঘাটোয়ারিবাবুর পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
আমি তোর বাচ্চাকে মেরে ফেলব! খুন করব বলছিস?
জী বাবু!
ঠিক বলছিস তুই?
জী ঠিক। আপ দয়া করেন বাবু।
নিমা বাগদী আকন্দ গাছটার নিচে সব শুনছে।
হরীতকী অফিসঘরে গেরুর কথা শুনতে পেল। এত রাতে গেরু বাবুর ঘরে কেন? সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকে।
গেরু বলে উঠল, বাবু?
ঘাটোয়ারিবাবু অন্যমনস্কভাবে জবাব দেন, ওঠ! যা! মড়াটা নিয়ে পুঁতে দে গিয়ে। তোর বাচ্চাটা তো বাঁচুক আগে। পাপ পুণ্যের কথা পরে ভেবে দেখব।
গেরু ডোম বের হয়ে গেল। নিমা বাগদী ঢুকল। গড় হলে ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, এখনও তবে বেঁচে আছিস?
আছি বাবু। নিমা বাগদীও ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘাটোয়ারিবাবু জানালা থেকে এখন আকাশ দেখছেন।
দূরে পুরনো অশ্বত্থের ছায়ায় ঘাসের নিচে তেমনি প্রজাপতিরা ডিম পারছে। তিনি তার উত্তাপ পাচ্ছেন। গভীর অরণ্যে হরিণ—হরিণীরা তেমনি ছুটছে, ছুটবে। তিনি আকাশ দেখেন আর ভাবেন। তিনি যেন আজ প্রথম আকাশ দেখছেন। আকাশে কত নক্ষত্র, আকাশে কত আলো! কত আনন্দ! কত আনন্দ এই জীবনধারণে। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে গভীর অনুতাপে পুড়তে থাকেন।
হরীতকী ঘরে ঢুকে দেখে বাবু জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন। সে ডাকে, বাবু।
ঘাটোয়ারিবাবু উত্তর দিতে পারেন না। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে গভীর এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায় দুঃখ পান।
বাবু উত্তর দিচ্ছেন না দেখে হরীতকী বিস্মিত হয়। ডাকে, বাবু।
হরীতকী ফের ডাকে, বাবু! বাবু বাবু!—হরীতকী ডেকে সারা হতে থাকে। বাবু জানালা থেকে মুখ তোলেন না। একবার বললেন না—কেন ডাকছিস? হরীতকী জোর করে বাবুকে টেনে নেয় জানালা থেকে। দেখে বাবু কাঁদছে।
বাবু তুই কাঁদছিস?
ঘাটোয়ারিবাবু পাগলের মতো হরীতকীকে বুকে টেনে আনেন, যাবি, যাবি তুই? যেদিকে দু চোখ যায়—এ চটান ছেড়ে অন্য কোথাও?
হরীতকী হেসে গড়িয়ে পড়ল।—বাবু বুলছিস কী তুই? শেষ বয়সে সোয়ামী—বৌ হয়ে সং সাজতে ইচ্ছা তুর। হরীতকীর হাসি আর থামছে না। এর লাগি কাঁদছিস তু বাবু?
জীবনের এই সং সাজার রাজত্বে আজ মনে হল ঘাটোয়ারিবাবুর—নিজেও এখানে সং সেজে বসে আছেন। সং সাজার রাজত্বে দুঃখবাবু, গেরু ডোমের সং সাজার সার্থকতা আছে। কারণ তাদের পাত্রপাত্রীরা চোখের জল ফেলবে কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু সারা জীবন ধরে সং সেজে সেটুকু উপার্জন করতে পারেননি।
হরীতকীর হাত ধরে তিনি বললেন, আমি মরলে তুই কাঁদিস। তিনি ধীরে ধীরে তারপর চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন। হরীতকী চলে গেল। রামায়ণ মহাভারতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন তিনি। রাত বাড়ছে রাত হালকা হচ্ছে। এই ধরণির কোলে প্রজাপতিরা সব ডিম পারছে। তিনি চোখ বুজে থেকে কোনো এক গভীর অরণ্যে চলে যাচ্ছেন, ধরণির বিচিত্র রকমের জীবনধারণের সঙ্গে ঘাটোয়ারিবাবুর আবার সেই ইচ্ছাটা জন্মাল—