ডেথ—সার্টিফিকেট থাকলে দেখাতে পারতেন।
নেই।
তবে থাক। বেশ, বেশ। পরম ব্রহ্মনারায়ণ। রসিদটা কাউন্টারে ফেলে দিয়ে এই সব কথাগুলো বললেন।
তারপর ঘাটোয়ারিবাবু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শীতের নদী বালিয়াড়িতে নেমে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্মশান দেখা যাচ্ছে না। শ্মশান বালিয়াড়িতে নেমে গেছে, সুতরাং শ্মশান দেখতে হলে ঘাটে নামতে হবে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ঘাটোয়ারিবাবু কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। ঘাট থেকে মানুষের কান্না ভেসে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি ইচ্ছা করেই যেন ডাকলেন এ গেরু, তোর বাপকে ডাক। কৈলাসকে কাঠ দিতে বল। তোরা ঘাটে কাঠ দিয়ে আয়। মড়াটা তাড়াতাড়ি জ্বলে যাক।
সেই সময় নেলি শুনতে পেল মড়াটার নাকে কানে গহনা আছে। গলায় গহনা আছে। দুখিয়া লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মংলি চিতা সাজানোর আট আনা পয়সা নিয়ে বচসা করছে। চিতা সাজানোর কাজ হরীতকীর। না থাকলে মংলি। মংলি বচসা করছে, আওর জায়দা লাগবে।
নেলি চটান থেকে ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে অনেক মানুষের ভিড়। চারপাশের লোকগুলো খুব কাঁদছে। নেলি ভিড়ের ভিতর গলাটা বাড়িয়ে দিল। মড়াটা দেখল। ওর হাতের কানের গহনা দেখল। গলার গহনা দেখল। গহনা সহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে বলে দুখিয়া পাহারায় আছে; কয়লা ধুয়ে কেউ গহনা চুরি করে না নেয়, অথবা ওর নসিবে কেউ যেন ভাগ না বসায়। নেলি মনে মনে বাপের ওপর রাগ করল। বাপ এক দফে ডাক নিল না ঘাটের। নসিব খুলার চেষ্টা কভি না করল। নেলির বলতে ইচ্ছে হল, তু বুড়বক আছে বাপ। দুখিয়ার নসিব দেখে নেলির পেটের যন্ত্রণা আরও বাড়ছে।
যেমন বেঁটেখাটো দুখিয়া, তেমন জংলি মরদ। মরদ মাগি সমান—কথায়, বচসায় নাচনে কোঁদনে সব কিছুতে। নেলি হাতের কানের গহনা দেখে দুখিয়া—মংলিকে দেখল চেয়ে। নেলি মংলিকে দেখে গাল দিল। কী লুকঝুক নতুন চাদরের লাগি! মংলির কদর্য মুখটা নেলিকে যেন ঘাটে বিব্রত করে মারছে। বিরক্ত করে মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলা নেওয়ার ইচ্ছায় গঙ্গা যমুনাকে লেলিয়ে দেবার এক তীব্র হিংসায় জ্বলে পুড়ে সে খাক হতে থাকল। মংলির চোখ তুলে নেওয়ার জন্য গঙ্গা যমুনা ওর একমাত্র ভরসা—ওয়ার মরদ বুলে কিনা হামি চোর! হামি চোর আছে। চোর আছে ত ঠিক আছে। চোর যখন আছে তখন ঘাটের গহনা ভি চুরি করে লিব। হেঁ লিব। জরুর লিব। নেলি মনে মনে এই সব বলে যেন শপথ নিল। —লিব। লিব। লিব। এ—ঘাট এখন ভালো লাগছে না। চটান ভালো লাগছে না। শ্মশানটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নিজের বাপের কথা মনে হল। বাপ হয়তো এখন হাসপাতালে লাশটার পেট চিরছে। নেলি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে এল। উপরে কাঠ বইতে হবে। কাঠ ফেলতে হবে ঘাটে। সুতরাং নেলি চটানে উঠে গেল। চটানে যাকে দেখল বলল—দুখিয়ার নসিব খুলে গেল। মংলির ভি নসিব। বহুত সোনাদানা ঘাটে এয়েছে। কয়লা ধুয়ে দুখিয়া সব গহনা লিয়ে লিবে। ডোমের কোনো বেটা—বেটিকে দুখিয়া ঘাটে কিছু ঢুঁড়তে দেবে না।
নেলি চটানে উঠে কয়েকটা কাঠ নিল কাঁধে। হরীতকীর দরজার পাশ দিয়ে ঘাটে নামার সময় ডাকল—পিসি!
হরীতকী দরজা থেকে মুখ বার করে জবাব দিল—বুল।
তু ঘাটে যাবি না পিসি? বহুত পয়সায়ালা ঘরের জোয়ান বেটি ঘাটে এয়েছে। বেটি কী খুবসুরৎ, তু যাবিনে ঘাটে?
না, যাব না।
ক্যানে যাবি না তু পিসি?
শরীর দিচ্ছে না। দুখিয়ার জবরদস্তি হামার ভালো লাগে না। ওয়ার ঘাটে হামি থুথু ফেলি। ভোরে তু ত চোর বনে গেলি। ও নালিশ দিল গোমানিকে, তু চোর। তু ওয়ার কাঁথা—কাপড় চুরি করে লিচ্ছিস।
এইসব শুনে নেলির কোমরটা দুলে উঠতে শুরু করেছে। মংলিকে বিদ্রুপ করার জন্য সাপের মতো জিভটা লকলকিয়ে উঠল। —মংলিটা বুলে কী পিসি! বুলে যা ঘাট অফিসে যা, ঘাটোয়ারিবাবুকে বুলে ভালো ভালো কাঠ লে। বিছানার চাদরটার লাগি কী লুকঝুক! লতুন চাদর, আহা মাটার কী সর্বনাশ পিসি! মংলি বুলছে চাদর, তোশক, বালিশে আগুন ধরাতে দেবে না। হাতের কানের গহনা ভি লেবে। অত ভালো লয় পিসি। তু কী বলিস?
হরীতকী জবাব দিল না বলে ফের বলল—পিসি!
বুল।
একজোড়া গহনা হলে হামি কতদিন খেয়ে লিব দেখে লিস। বাপকে কত বুললাম তু ঘাটের ডাক লে এক দফে। দেখে লিবি তখন কত সুখ হামাদের। কত গহনা! এক দফে যদি লিত পিসি!
তুর বাপ পচাই খাবে না ও কাম করবে? দুরোজ আগে দেখলাম মাচানের নিচে বসে ওত ইসপিরিট খাচ্ছে। হাসপাতালসে চুরি করে ইসপিরিট লিচ্ছে। তুর বাপ মরবে। জলদি ও পার পাবে দেখে লিবি। খাবে না, দাবে না—পেট ওয়ার জরুর পচবে।
খড়ম পায়ে তখন ঘাটোয়ারিবাবু ঢুকছেন চটানে। খড়মের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হরীতকী তাড়াতাড়ি কাপড় সামলে বসল। বাচ্চাটাকে কোলে নিল। আদর করল। নেলি তখন চটান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘাটোয়ারিবাবু ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বকবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে এ—কথা বলবে। কিন্তু নেলি দু কদম সরে না যেতেই তিনি ডাকলেন—কাজে খুব ফাঁকি দিচ্ছিসরে।
না বাবু। বাবু, ওরা গহনা পুড়িয়ে দেবে না লিয়ে যাবে? নেলির ইচ্ছা গহনা ওরা নিয়ে যাক। গহনা না পুড়িয়ে শুধু মানুষটা পুড়িয়ে দিক। দুখিয়ার নসিবে আগুন লাগুক।
ঘাটোয়ারিবাবু ধমক দিলেন নেলিকে—তার আমি কী জানিরে ডোমের মেয়ে! আমি কী মড়ার মালিক! কী কথা বলেগো মেয়েটা! কাজে যা কাজে যা। যা করছিস তাই কর। গহনা গহনা করিস না। গহনা দিয়ে কিছু হয় না। তারপর ঘাটোয়ারিবাবু চারদিকে চাইলেন—তখন নেলি গঙ্গায় নেমে যাচ্ছে। কাঠ সাজাচ্ছে ঝাড়ো। সোনাচাঁদ অফিস থেকে ফিরে এসেছে। ঝাড়ো ডোমের বৌ বাঁশের পাতি তুলছে বঁটিতে। কৈলাসের শেষ বৌটা মানুষের কঙ্কাল সিদ্ধ করছে সোডার জলে। ঘাটোয়ারিবাবু এইসব দেখতে দেখতে হরীতকীর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজার ওপর ঝুঁকে বললেন, বাচ্চাটাকে দেখা। একবার দেখা। বাচ্চাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, শেষ পর্যন্ত শ্মশানেই বাচ্চা বিয়োলি! বাচ্চাটা বাঁচবে অনেকদিন।