গেরু বলল, থোড়া বাদ আসছে বাবু। সে হারুকে নেলির পাশে রাখতে যাচ্ছে।
ঘাটবাবু শিবরাম ঘোষ জানালায় বসে অপেক্ষা করলেন। দেয়ালে হারিকেনটা নিবু নিবু হয়ে জ্বলছে। দুঃখবাবু বিকেলে ছেলেপিলের গল্প করে গেছেন। গল্পগুলো এত ভালো লেগেছিল যে তিনি চটানে বসে থাকতে পারেননি—তিনি দুঃখবাবুর সঙ্গে শহর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। দুটো কমলালেবু কিনে দিয়ে বলেছিলেন, ওদের দেবেন। বলবেন, তোদের জ্যাঠামশাই দিয়েছে।
তিনি বসে বসে এমন সবই ভাবছিলেন। ভাবছিলেন হয়তো দুঃখবাবু ওর দেওয়া কমলালেবু দুটো ওদের হাতে দিয়েছেন। ওরা খুশি হয়েছে। হয়তো দুঃখবাবুর স্ত্রী বলেছেন একবার নিয়ে এসো না ওনাকে। একদিন এখানে দুটো খাবেন। অথচ তিনি ধরতে পারলেন না কখন হারুকে চুরি করার মতলবে গেরু নেলির ঘরে ঢুকছে, কখন সে নেমে গেছে নদীতে। তিনি ভাবলেন, এই গেরুকে একটু বকতে হবে। গেরুকে সাবধান করে দিতে হবে। তিনি গেরুর অপেক্ষাতে জানালার ধারে বসে থাকেন।
বাবু।
গেরু বুঝি এল। তিনি চোখ তুললেন।
কে? অঃ গেরু—আয়।
গেরুকে পাশে বসতে বলে বললেন, তুই নেলির বাচ্চাকে নিয়ে যখন তখন চটান থেকে নেমে যাবি না।
যাবে না বাবু।
তুই মনে করবি না আমি কিছুই টের করতে পারি না।
গেরু চুপ করে থাকে। ঘাটোয়ারিবাবুর পায়ের কাছে বসে মুখ নিচু করে থাকে।
তুই মনে করবি না তোর চালাকি কেউ টের পায়নি।
গেরু এবার মুখ তুলে বাবুর দিকে তাকায়।
তুই মনে করবি না বাচ্চাটা শুধু নেলির, বাচ্চাটা আমার। ওটা আমার পায়ের কাছে মানুষ। ওর শরীরে আমার রক্ত না থাকতে পারে। কিন্তু আমার ভালোবাসা আছে। বলতে বলতে সহসা চুপ করে যান। জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখতে দেখতে উদাসীন হয়ে যান।
বাবু!
বল।
বাবু একটা কথা বললে রাগ করে লিবেন না?
কী কথা বুলবি?
বাবু একটা মড়া এয়েছে ঘাটে। নিমা বাগদীর মড়া। ঠিক করে বুললে আপনি হয়তো চিনে লিবেন। সাঁইথিয়ার নিমা বাগদী। মড়া বেচে আদমীটা মদ খায়। আপনি জরুর চিনে লিবেন। ও হামারে মড়াটা দিয়ে দিতে চায়। বুলে দিন না বাবু। গেরু বাবুর পায়ের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। পা দুটো ছুঁতে চাইল। চোখ দুটো ফের নরম করে ডাকল, বাবু।
ঘাটোয়ারিবাবু একটু সরে বসলেন—এ কী হচ্ছে। তুই অসময়ে আমার পা ছুঁবি না।
গেরু যথার্থই আর ছোঁয়ার চেষ্টা করল না। চোখ দুটো ভারী করে বলল, দুরোজ ভুখা আছে বাবু। দু রোজ দানা—পানি কিছু পড়ছে না পেটে। ঠাকুর ভি ধারে দিচ্ছে না। বৌটা না খেয়ে মরে যাবেক বাবু।
ঘাটোয়ারিবাবু চোখদুটো উদাসীনের মতো করে রাখলেন। গেরুর কথা তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন না।
গেরু দুটো হাত মেঝের ওপর রাখে। হাত দেখানোর মতো করে রাখে। বলে, বাবু আপনি চটানের মা—বাপ।
ঘাটোয়ারিবাবুর চোখ দুটো জ্বলতে থাকে। চোখের মণি দুটো ঘুরতে থাকল যেন। ভাগ, ভাগ। শালা ভাগ। তিনি খিস্তি করতে আরম্ভ করলেন। আমি না—বাপ! ছেলেপুলে নেই, ঘরসংসার বলতে কিছু নেই—আমি চটানের মা—বাপ? আমি মরলে তোরা কখনও কাঁদবি? তোরা চোখের জল ফেলবি? তোদের পাষাণ আত্মা আমার জন্য চোখের জল ফেলবে? শোক করবে? ঘাটোয়ারিবাবু কথাগুলো বলতে বলতে গভীর বেদনায় ভেঙে পড়লেন। গেরু মাথা নিচু করে যেমন বসেছিল, তেমনি বসে থাকে।
ঘাটোয়ারিবাবু রামায়ণ মহাভারত দুটো ঠেলে দিয়ে কাউন্টারটা খুলে দিলেন। লোকগুলো এখনও আসছে না—তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি মড়ার নামধাম রেজেস্ট্রি খাতায় তুলে শুয়ে পড়বেন। আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। জেগে থাকতে ভালো লাগছে না। গেরুকে উঠতে না দেখে বললেন, টাকা চাই? টাকা—নেবার সময় ত মনে থাকে না!
গেরু ডোম চোখ তুলল না। বাবুর পায়ের ওপর চোখ রেখেই বলল টাকা হামার লাগে না বাবু! আপনি কত দিয়ে লিবেন?
তবে কী চাই! কী চাইরে কৈলাসের ছা! নেমকহারাম পাষণ্ড! আমি কী দিতে পারি তোকে!
বাবু আপনি ইচ্ছা করলে সব দিতে পারেন। মড়াটা ফুলে—ফেঁপে গেছে বাবু। মড়াটা হামারে দিয়ে দিতে চায় বাবু। আপ বুলেন ত হামি লিয়ে লি। লয়ত হাম মরবে, বিবিটা ভি মরবে বাচ্চাটা ভি মরবে।
ঘাটোয়ারিবাবুর মনে হল তিনি ভুল শুনেছেন। মনে হল গেরু ওর সঙ্গে মস্করা করছে। অথবা তঞ্চকতা করছে।
গেরু ফের বলে, হামার বাচ্চাটা ভি মরবে বাবু!
তোরও বাচ্চা হল রে গেরু। গেরুর বাচ্চা হবে জেনে তিনি চেয়ারে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ঘরের ভিতরেই দ্রুত পায়চারি করতে থাকলেন। একবার ঘাটের দিকে, একবার চটানের দিকে মুখ ফেরাতে থাকলেন। রাত বাড়ছে তখন। রাত ঘন হচ্ছে। দূরে কোনো পুরনো অশ্বত্থের ছায়ায় ঘাসের নিচে প্রজাপতিরা ডিম পারছে যেন! ডিমের উত্তাপ এ শরীরে এসে তা দিচ্ছে। তিনি এখানে দাঁড়িয়ে হরিণ—হরিণীর জলপান করার শব্দ পেলেন। তারপর দেখতে পেলেন ওরা সব গভীর অরণ্য হয়ে গেছে। গভীর অরণ্যে ঐসব হরিণেরা ভালোবাসার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। যেন কোনো নীহারিকার অতীত থেকে এ বর্তমান শুধু চিহ্ন রেখে যাওয়া। ডিম পেড়ে যাওয়া—হরিণেরাও ডিম পাড়ে—এমন ভাবতেই ঘাটোয়ারিবাবুর ভালো লাগছে। কালের অবক্ষয়ে ইচ্ছার জন্মকে তিনি কোনো সুখী পরিবারে আটকে রাখতে পারলেন না। তিনি শুধু জেনেছিলেন মৃত্যু—মৃত্যুই সব। মৃত্যুর কড়া—ক্রান্তির হিসাবে তিনি কেমন অবিশ্বাস্যভাবে এতদিন এই চটানে…একটা চটানে—বাঁজা হরিণ হয়ে ছুটেছিলেন। গেরুর বাচ্চা হবে জেনে এ সময় হরীতকীকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছা হল। একটা বাঁজা হরিণের মতো না বেঁচে একটা ফলন্ত হরিণের মতো বাঁচতে ইচ্ছা হল ওঁর।