গেরু কোমর জলে গিয়ে নামল। সে বুঝতে পারছে হারু তেমনি ওর কোলে অভিমান ভরে মুখ ফিরিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে সোহাগ না করলে, ভালোবেসে কথা না বললে সে মুখ ফেরাবে না। সে যে কী করে! সে বুকের ওপর থেকে হারুকে জলের কাছে কাছে নামিয়ে আনল। ধীরে ধীরে জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। হারুর পা দুটো জলে নেমে যাচ্ছে। হারু কিছু বলছে না। প্রচণ্ড অভিমানে সে এখনও মুখ ঘুরিয়ে আছে। অভিমানে হারুর মুখ থমথম করছে। দু চোখে জলের ধারা নামছে। জ্যোৎস্নায় চকচক করছে কিন্তু কোনো ভয় নেই শঙ্কা নেই। অভিমানে চোখ ফেটে হারুর জল বের হয়ে আসছে। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে অথচ কাঁদছে না। দুজনের ছায়া গেরু জলে দেখতে পায়। আর তখনই গেরুর মধ্যে কী যে হয়ে যায়। জগৎ সংসার এবং পৃথিবী বড়ই ভালোবাসার। ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আকাশের আলো, বালিয়াড়ির সাদা রঙ, একটি বিস্কুটের স্মৃতি এবং হারুর এই অবোধ অভিমান গেরুর মনে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছে। সে যত ওকে জলে ডুবিয়ে দিতে চাইছে, তত যেন সে ওকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবেসে ফেলছে। সে যেন দেখছে—নেলির দুটো ভিজে চোখ বলছে, হামার সাত রাজার ধনকে তু খুন না করিস। এবং তখনই দেখল হারু ওর দিকে চেয়ে হাসছে। ফের হাজার রকমের কথা বলছে, গেরু—চা—চা—তু—হামারে চু—উ—না—দিবি।
গেরু নিজেকে আর কঠিন কঠোর করে রাখতে পারে না। সে আর নৃশংস হতে চায় না। সে বরফের মতো গলে গলে পড়ে। কোমর জলে হারুকে বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পায়ের কাছে দুটো মাছ নড়ছে। জল কাঁপছে, ওদের ছায়া দুটো কাঁপছে। আকাশের একটুকরো চাঁদ তখন নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় নেমে যাচ্ছে। ধরণি শান্ত। কোথাও কোনো ভয়—ভীতির চিহ্ন নেই। কোথাও কোনো সংশয় নেই। সন্দেহ নেই। গেরুর হাত—পা এখন কাঁপছে না। সে ধীরে ধীরে বালিয়াড়ি ভেঙে ওপর উঠল।
হারু ফের বলে, তু—চু—উ—দে চাচা।
জরুর দেবে। হামি তুরে চুমু না দেবে ত কোনো দেবে? হারুর কপালে গেরু চুমু খেল। যেমন করে রোজ গালটা মুখটা ওর নরম গালে ঘষে দিত আজও তেমনি ঘষে দিল। গেরু সুখ পেল, আনন্দ পেল। হাকিমি দানরির কথা ভুলে গেল। ভুলে গেল সে আজ দুদিন ধরে ভুখা আছে। সে ভুলে গেল হারুকে কিছুক্ষণ আগেও সে খুন করার কথা ভেবেছে। ওর শরীরে মনে যে অস্বস্তি এতক্ষণ হচ্ছিল, পাড়ে উঠে সব কেমন উবে গেল, নিঃশেষ হয়ে গেল।
একদল বাদুড় উড়ে গেল নদীর অন্য পারে। কিছু শেয়াল ডাকে ডহরের পারে। খানা—খন্দে, ঝোপ—জঙ্গলে পাখিরা সব প্রহরে প্রহরে ডাকছে। ধীরে ধীরে গেরু বালিয়াড়ি ভাঙে। পায়ের ছাপ পড়ছে বালিয়াড়িতে। সে হেঁটে যাচ্ছে। কাঁধে হারু হাজার রকমের কথা বলে খুশি হচ্ছে।
ধীরে ধীরে গেরু চটানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে শ্মশানটার কাছে এসে দেখল চালাঘরে চার—পাঁচটা লোক বসে বিড়ি টানছে। চালাঘরটার পাশেই মড়াটা রাখা রয়েছে। শিয়রে হারিকেন জ্বলছে। মড়াটা চাদরের নিচে থেকেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গেরু মড়াটা দেখে ধরতে পারল গন্ধ নিয়ে ধরতে পারল—মড়াটা পচে গেছে। সে দাঁড়াল মড়াটার কাছে। লোকগুলো কিছু বলছে না। ওরা জানে গেরু চটানের লোক। ওরা এখানে আরও কতবার মড়া বেচে অথবা পুড়িয়ে চলে গেছে। গেরু ওদের চিনতে পারল। গেরু ওদের মতো করে কথা বলল।—গেল সালে তোমরা এয়েছিলে নাকো মোড়লের বেটা?
ভিতর থেকে বুড়ো লোকটা উত্তর করল, হ্যাঁ এয়েছিলাম বটে। তুর বাপ বেঁচে নেই। এখন আর আমাদের কে চিনবে!
গেরু বলল, না চিনলে চলবে কেন? না চিনলে বললাম কী করে তুমরা গেল সালে এসেছিলে!
বুড়ো লোকটা জবাব দিচ্ছে।—গেল সালের মড়াটা তো পুড়িয়েই যেতে হলরে বাপু। তুই চিনতে পেরেই আর কতটা উপকার করলি।
গেরু বুঝল ওরা মড়াটা বিক্রি করতে চায়। বুঝল, ওরা বিশ ক্রোশ, পঁচিশ ক্রোশ পথ ভেঙে মড়াটাকে গঙ্গা পাইয়ে দিতে এসেছে। গঙ্গার জলে চুবিয়ে মড়াটা ইচ্ছে করলে ওরা বিক্রি করতে পারে। ইচ্ছে করলে এমনি দিয়ে যেতে পারে। ইচ্ছে করলে কাঠের পয়সায়, ঘাটের পয়সায় ওরা ফুর্তি করতে পারে। গেরু জানে, কৈলাস বেঁচে থাকলে মড়াটা নিয়ে নিত বাবুকে বলে। বাবু রসিদ লিখতেন অথচ কাঠ পুড়ত না। অথচ টাকা পেতেন কিছু, ওদের কাঠের দাম লাগত না। ঘাটের দাম লাগত না। সে পয়সায় নিমা বাগদীর লোকেরা মদ খেত, ফুর্তি করত। গাঁজাভাঙ খেয়ে পাশের একটা বস্তিতে উলঙ্গ হয়ে নাচত।
গেরু বলল, মড়াটা আমি নিলে দেবে আমাকে?
নিবি তুই! নিলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।
গেরু বলল, তবে জলদি হারিকেনের আলোটা নিভিয়ে দাও। বালিয়াড়িতে নেমে চুপচাপ বসে থাকো।
দুদিন খেতে না পেয়ে গেরুর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। মড়াটা পাবে ভেবে শুকনো মুখটা ফের খুশিতে ভরে উঠল। সে হারুকে কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি চটানে উঠে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ঘাটোয়ারিবাবু ডাকলেন কে যায়?
হামি গেরু আছে বাবু।
কোথায় গেছিলি নেলির বাচ্চাকে নিয়ে?
নদীর ধারে বাবু।
নদীর ধারে গেছিলি। কেমন সন্দেহের গলায় বললেন ঘাটোয়ারিবাবু।
হে বাবু নদীর ধারে। দুরোজ ভুখা থেকে নিদ নেই আতে বাবু! গেরু মনে মনে খুব খুশি হচ্ছে। খুব বুদ্ধি করে কথাটা বলতে পেরেছে ভেবে সে খুব খুশি। ও পা বাড়ায় চটানের দিকে।
ঘাটোয়ারিবাবু আবার ডাকলেন, যাস না কথা আছে।