দরজায় জবুথবু হয়ে শনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ওর ইচ্ছা হল চিৎকার করতে। ইচ্ছা হল বলতে, গেরু তু না যাস। গেরু তু খুন মতো কর। হামি তুর সাথে যাবে, তুর সুবিধা অসুবিধা দেখবে। কিন্তু গেরুকে তখন দেখা যাচ্ছে না। নেলির ঘরেও কোনো চিৎকার উঠছে না। সে দরজায় দাঁড়িয়ে হারু কিংবা নেলির চিৎকার শোনার অপেক্ষায় রইল।
নেলি যদি মাচানে জেগে থাকত, সে দেখতে পেত, দুটো ভয়ংকর হিংস্র হাত ওর মাচানের ওপর এগিয়ে আসছে। সে দেখতে পেত, গঙ্গা—যমুনা চোখ তুলে তাকিয়ে পরিচিত জন বলে কিছু বলছে না। গেরু প্রথমে গঙ্গা—যমুনাকে আদর করল। দুটো মুড়ি দিল খেতে। শেষ মাচানের ওপর ঝুঁকে ঘুমন্ত হারুকে কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে চটান থেকে ভালোমানুষের মতো নেমে গেল। হারুকে নিয়ে যেন বেড়াতে যাচ্ছে এমন ভাব গেরুর।
সকলে তখন ঘুমোচ্ছে চটানে। কেবল শনিয়া ঘটনার সাক্ষী হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। অথচ বাচ্চাটা একবারও কেঁদে উঠল না। সে বিস্মিত হয়ে কেবল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল। গেরু কোনো পথ ধরে চটান থেকে নেমে যাচ্ছে দরজায় দাঁড়িয়ে সে তা ধরতে পারছে।
গেরু চটান থেকে ছুটতে থাকল। কার্তিক মাস শেষ হয়ে আসছে। কার্তিক মাসের রাত্রি। নদী এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। সে নদীর পাড় ধরে ছুটল। হারু ভয়ে এখন চিৎকার করলেও চটানের কেউ শুনতে পাবে না। ঘাসের ওপর শিশির পড়েছে। সে শিশির মাড়িয়ে চলল। রাতের কোনো পাখি ঝোপে জঙ্গলে ডাকছে না। ওপারে ট্রেনের শব্দ নেই অথবা আলো এসে পড়ছে না। সুতরাং সে ছুটতে থাকল। চোরের মতো নদীর পাড়ের দিকে ছুটছে।
সহসা কোনো প্রবল ঝাঁকুনিতে হারুর ঘুম ভেঙে গেল! সে ভয় পেল। সে দেখল আঁধারে কে যেন ওকে মাটি থেকে তুলে নিচ্ছে। কে যেন ফের ওকে নিয়ে ছুটছে। সে এবার কেঁদে উঠল। সে জোরে কাঁদতে থাকল।
গেরু ওর কান্না শুনে থামল। মুখের কাছে মুখ এনে বলল, তু চিনতে লারছিস। হামি তুর গেউ চাচা। তুকে নিয়ে হাম মেমান বাড়ি যাচ্ছে। তু রোনেসে আদমি লোক আচ্ছা না বুলবে হারুয়া।
গেরুকে চিনতে পেয়ে হারু নির্ভয় হতে পারছে। কার্তিক মাসের রাত। শীত শীত করছে হারুর। সে গেরুর শরীর জড়িয়ে থাকল। শরীরের উত্তাপ নিতে চাইল। বলল, গেউ চাচা মায়ী যাব। তু—উ মায়ী যাবি না? টু…প…লে…না।
হে, যাবে। জরুর যাবে। তুর মাইকা পাশ জরুর যাবে। লেকিন আভি কথা বুলে না। বাপ ত আচ্ছা আছে। গেরু যত হারুর সাথে কথা বলছে তত যেন ওর ভয় বাড়ছে। সে চলতে চলতে ভাবল ফরাসডাঙায় জঙ্গলে পোড়া বাড়িটাতে রাত কাটাবে। হারুর শরীরটা চাদরে পেঁচিয়ে ভাঙা পাঁচিলের আঁধারে ফেলে রাখবে। ভোররাতের দিকে কাঁঠাল গাছটার নিচে পুঁতে দেবে। তারপর সে কিছুদিন এধার ওধার করে বেড়াবে। কিছুদিন জল ঢালবে হারুর শরীরটার উপর। হারুর শরীর পচিয়ে বাঁ হাতের হাড় সংগ্রহ করবে। হাড়টা গঙ্গা জলে শুদ্ধ করে শ্মশানে কালীর পুজো দেবে একটা। শেষে সে বের হয়ে পড়বে। গাছগাছালি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। সঙ্গে শনিয়া থাকবে, বাচ্চাটা থাকবে। বাচ্চাটা বাপ বলে ডাকবে। গেরু বলবে, শিখে লে শালা, এর নাম জীবন হাড়। এ হাড় দু—শ পচিশ দফে বেইমান মানুষের কাজে লাগে। জড়িবুটি, দ্রব্যগুণ, মন্তর—তন্তর এ সবের জেরাছে কারবার।
হারু গেরুর কাঁধে হাত—পা নেড়ে এখন খেলছে। অজস্র কথা বলছে। গেরু চাচার সঙ্গে ঘুরতে পেরে হারুর এ আঁধার খুব ভালো লাগছে। অন্য দিনের মতো বুকের ওপর হারু পা দুটো নাচাল। দোলাল। হাত তুলে আকাশের ছোট চাঁদকে ডাকল। গেরুর কপালে টিপ দিল। হাসল। সে অজস্র রকমের কথা বলে গেরুকে অন্যমনস্ক করতে চাইছে। সে ডাকল, গেউ চাচা…উ….উ….আ….আ। দূরে শেয়াল ডাকে। সে বলে বা…যা…জি…ভি। ..জু…জু। গে…উ চা…চা। পু….পু। হারু যেন এই কাক জ্যোৎস্নায় মেমান বাড়িই যাচ্ছে। কোনো ভয়ডর অথবা শঙ্কা জাগছে না। কোনো সংশয় জন্মাচ্ছে না। গেরু চলতে চলতে দেখল রাজ্যের সব ভয় ওকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। হারুই যেন গেরুকে নিয়ে যাচ্ছে জলে ডুবিয়ে মারার জন্যে। গেরুর হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। হারু যত ঘাড়ে বসে রাজ্যের কথা বলে যাচ্ছে, তত গেরু বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে। বিরক্ত হয়ে পড়ছে। হারুর সরল কথাবার্তায় গলা শুকিয়ে উঠছে গেরুর। সে এগোতে পারছে না। এগোতে কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে এক্ষুনি হারুকে মাটিতে আছড়ে অথবা গলা টিপে মেরে ফেলতে, কিন্তু সেই শরীর থেকে জীয়ন হাড় পাবে না ভেবে সে বিরক্তিতে চিৎকার করে ওঠে, হারু তু থাম, তু থাম। সে চোখ মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে। হারু পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গেরুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে চুল ধরে টানতে থাকে। গেরুর মুখ দেখতে চায়। মুখ দেখে বলতে চায় গে…উ…চা…চা…তু…ভা…ল। হামি…ভা…ল। না…গে…উ….চা…চা।
হারুর মুখের দিকে চেয়ে গেরু ফের চিৎকার করে উঠল, তু থাম! তু থাম? গেরু কী ভেবে হারুকে কোলে তুলে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকে। বেশি দেরি করলে সে যেন ধরা পড়বে। বেশি দেরি করলে সে নিজেই খুন হয়ে যাবে। সে ছুটে ছুটে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকে, আর বলতে থাকে, তু থাম।
গেরু জোরে ধমক দেওয়ায় হারুর কেমন অভিমান হল। গেউ চাচা ওকে বকছে। হারুর অভিমান বাড়ছে। সে মুখ ফিরিয়ে রাখে। সে কথা বলে না। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে চায়। গেরু অন্যদিনের মতো বলতে পারছে না, আয় বাপ তুকে কিছু না বুলবে। সে বলতে পারল না, অথচ ওর কষ্ট হতে থাকল। জলের দিকে সে যত নেমে যাচ্ছে কষ্টটা যেন তত বাড়ছে। তত আগেকার কথা নদীর ভরা বর্ষার কথা, একটি বিস্কুটের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যত এই সব মনে হয় ততই সে জোরে ছুটতে থাকে। সত্বর সে ওকে জলে চুবিয়ে নিশ্বাসটা বন্ধ করে দিতে চায়।