ঘাটোয়ারিবাবু ধমক দিলেন, এই তুই এখানে কেন? তোর মা কোথায়?
হারু বড় বড় চোখে তাকাল। বাবু যে ওকে ধমক দিচ্ছে ও বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে সে কাঁদল।
ওঃ কাঁদা হচ্ছে। আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি। একা একা কোথাও যাবি না। তোর মা কোথায়? মাকে ডাক, কথাটা বলে দি। দিনকাল খুব খারাপ।
হারু কিছু বুঝতে পারল না। সে একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লাঠি দিয়ে মেঝেতে বারবার আঘাত করল। সে বাবুর মতো আকাশ কিংবা পাখি দেখলে না। দেয়াল ধরে টিকটিকি নামছে। সে লাঠি দিয়ে টিকটিকিটা মারতে গেল। হাত দিয়ে ধরতে গেল। ভয়ে উপরে উঠে গেল টিকটিকিটা। নাগালের বাইরে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। হারু টিকটিকিটা ধরতে না পেরে রাগে বাইরে ফেলে দিল। তারপর ভিতরে ঢুকে বাবুর পায়ের কাছে বসল। বাবুর পায়ের চুল ধরে টানতে থাকল।
এই শালা ব্যথা পাচ্ছি। ব্যাটা তো দিন দিন খুব পাজি হয়ে উঠছে। তুই যে লোম ধরে টানছিস আমি ব্যথা পাই না রে?
হারু বলল, বাউ…ত…ত।
ঘাটোয়ারিবাবু সোহাগ করলেন, বাউ—ত—ত—। আমি বুঝি তত বাবু?
টিকটিকিটা দেয়ালে ক্লপ ক্লপ করল। ক্লপ ক্লপ করে টিকটিকিটা একটা মাছিকে আক্রমণ করছে। ঘাটোয়ারিবাবু ক্লপ ক্লপ শব্দ শুনলেন। তিনি বাইরে এসে টিকটিকি দেখলেন। দেখছেন। মাছিটা দূরে গিয়ে বসেছে। টিকটিকিটা উপরে উঠে গেল। কোনো আক্রমণের ইচ্ছা এখন আর নেই। বড় শান্তশিষ্ট জীব। তিনি দেখলেন টিকটিকির চোখ, মুখ গেরুর মতো এবং হারু মাছি হয়ে দেয়ালে উড়ছে। টিকটিকিটা আনন্দে দেয়ালে লেজ নাড়ে। এইসব দেখে, কৈলাসের প্রেতাত্মা গেরুর চোখে ঘুম নেই—ঘাটোয়ারিবাবু যেন টের করতে পারছেন। গেরুর হাকিমি ব্যবসাটা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না। গেরু ফের কোর্ট—কাছারি যেতে আরম্ভ করেছে। ফের রসল্লা দিচ্ছে ঘরে।
যতদিন যাচ্ছে গেরুর অভাব তত বাড়ছে। নেলি রোজ রাতে কিংবা দিনে বের হতে পারছে না। চটানের ওপর দিয়ে আশ্বিন মাস গেছে কার্তিক মাস যাচ্ছে। গেরু শুধু রসল্লা দিয়েই যাচ্ছে। দুঃখবাবু এসে শুধু গল্প করছেন, কোনো কাজের নাম নেই। এবার একটু চাপ দিতে হবে। খড়ি কাঠ নেই। কাঠ সংগ্রহের জন্য ওকে যেতে বলতে হবে। অনেক কাঠের দরকার হয়ে পড়েছে। কিছুদিন থেকে খুব মড়া আসতে শুরু করেছে ঘাটে। কার্তিক মাসের টানে বুড়োরা মরছে খুব। রোজ তিনটে চারটে করে আসছে। জ্বলছে। খুব দূর থেকে আসছে সব—দশ ক্রোশ, বিশ ক্রোশ হবে। তখনই মনে হল তার, কালের ঘণ্টা কে বাজায়!
হারু হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে বারান্দায়। কোনো ভয়ডর নেই। নেলি চটানে পড়ে আছে ক’দিন থেকে। ঝাড়োর ঘরে পাতি তুলছে। হারুকে দেখে বুড়ো মানুষেরা মরছে খুব এ—কথাটা কেন যে মনে হল তাঁর। তিনি তাঁর শরীরের সব গ্রন্থিগুলো দেখে বিষণ্ণ হলেন। মৃত্যুর ইচ্ছা এ শরীরে যেন প্রকট হচ্ছে। মৃত্যু—মৃত্যু—মৃত্যু। তিনি বারান্দায় পায়চারি করার সময় উচ্চারণ করলেন। তিনবার তিনি ঈশ্বরের স্মরণ নিলেন। তিনবার তিনি সকলের অলক্ষ্যে হারুকে প্রদক্ষিণ করলেন। যেন হারু ওঁর সন্তান। অথবা হারু তাঁর এক অন্য জীবনের প্রতীক। হারুকে দেখলে ওঁর মন অযথা খুশির ইচ্ছায় উদার হতে থাকে। তখন বাঁচার ইচ্ছা তীব্র হয়। তখন পৃথিবীর কুটোগাছটা পর্যন্ত অর্থবহ মনে হয়। তখন চটান ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য পৃথিবীর মানুষ হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা হয়। মৃত্যু—নরক এবং যন্ত্রণার প্রতীক।
যে ভোরে তিনি এমনসব ভাবছিলেন, সে রাতেই ঘটনাটা ঘটল। দুঃখবাবু ঘরে ফিরে গেছেন। কাকপক্ষীর কোনো সাড়া নেই চটানে। মদ খেয়ে হল্লা করছে কেউ। রাত না নামতেই চটানটা নিঝুম হয়ে গেছে, কেমন ফাঁকা ফাঁকা কেমন নিঃসঙ্গ। নেলি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছে মাচানে। গঙ্গা—যমুনা, নিচে ঘুমিয়ে আছে। হারু অন্য পাশটায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বলে তিনি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। ঘাটে কোনো মড়া জ্বলছে না। ওপারে রেলের শব্দ পর্যন্ত সে রাতে ওঠেনি। ট্রেনটা যেন কোথাও আটকে আছে। অথবা কোথাও আটকে গর্জাচ্ছে, ফুঁসছে। রাতের ঘন আঁধারে লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর দূত যেন পায়চারি করে বেড়াচ্ছে চটানে। লক্ষ লক্ষ প্রেতাত্মা যেন উড়ছে চটানের উপর।
গেরু দরজা দিয়ে বের হবার সময় শনিয়া হাত টেনে ধরল—তু না যাস গেরু। হামার কীরা। তু না যাস। ও কাম করতে হবে না। হামি উপুস করবে, মরবে লেকিন তু এ কাম না করবি।
গেরুর চোখ দুটো জ্বলছে! হিংস্র এবং অমানুষের মতো লাগছে গেরুকে দেখতে। সে বলল, তু হাত ছেড়ে কথা বুল মাগি। তু জায়দা ঢঙ মাত দেখা আভি। হামি এক রাতে জরুর ফিরে আওগে। তু হাম কাঁহা ভি চল যাউগে। বলে গেরু জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল! কৈ আদমি তুকে কিছু বুলে তো তু বুলবি হামি না জানে ও কাঁহা গেছে! এ বাত তু মনে রাখিব। লয়তো তু ভি খুন হো যাবি চটানে—বুলে দিলাম।
তারপরই গেরু চটানে নেমে কেমন হিহি করে কাঁপতে থাকল। বড় শীত করছে। হাত পা শিথিল। চটানে নেমে ওর মনে হচ্ছে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রথম রাতে মড়া তুলতে গিয়ে ফরাসডাঙায় যেমন তার হয়েছিল চোখে—মুখে, মনে সে ভাবটা হুবহু কাজ করছে এখন। মনে হচ্ছে দূরে কেউ যেন শোকের কান্না কাঁদছে। গলা টিপে ধরলে যে শব্দটা গলা থেকে বের হয়—সে শব্দটা কাছাকাছি কোথাও উঠেছে। অথবা কোনো মানুষকে জলের নিচে শ্বাস বন্ধ করে মারলে ফুসফুসের রংটা যা হয়, ওর চোখে সেই রং। সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। সে যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তবু তবু সে যাচ্ছে। তবু তবু সে হাঁটছে। কোমরে চাদর বাঁধল গেরু, গামছা দিয়ে মাথাটা পেঁচিয়ে নিল। তারপর কিম্ভূতকিমাকার মানুষ হয়ে একটা ভয়ংকর শ্বাপদের মতো চটানে হামাগুড়ি দিতে থাকল। আঁধারে গেরুকে আর দেখা যাচ্ছে না। গেরু হাঁটছে—হাঁটছে।