কোথায় যেন চলে যায় নেলি—ফিরতে গভীর রাত করে। মালসা মালসা খাবার আনে। হারুকে পেট ভরে খেতে দিয়ে সকলকে মুঠো মুঠো দেয়। নিজে খায় পেট ভরে।
ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শনিয়া দিন দিন শুকনো কাঠ হয়ে যাচ্ছে। চুরি—চামারি করে গেরু আজকাল যা হচ্ছে—শনিয়াকে সে কথা জানতে দিচ্ছে না। পয়সায় সে কেবল মদ গিলছে। মদ গিলে আজকাল কেমন চেহারা হয়ে উঠেছে, কেমন বেলেল্লাপনা করতে শিখেছে। দুনিয়াতে কিছুই তার আর ভালো লাগছে না। শুধু হারুকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে ভালো লাগছে। কোথাও বসতে অথবা ওকে ভালোবাসতে ভালো লাগছে। যত এমন হয় তত ওর একটা বাচ্চার শখ জাগে। ওর বাপ হতে ইচ্ছা হয়। হারুর মতো রাজ্যের পাখি টিকটিকিদের সঙ্গে কথা বলুক ওর বাচ্চাটা এই শখ মনে মনে। যত এই সব মনে হয়, তত হারুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছা করে। তত সে হারুকে কাঁধে করে মাঠ, নদী, বন পার হয়ে যায়।
গেরু কোনো কোনোদিন হারুকে কাঁধে নিয়ে নদীর পারে সূর্য ওঠা দেখে। সূর্যাস্ত দেখে, নক্ষত্র দেখে! পৃথিবী, আকাশ, গাছপালা পাখি দেখে। ওরা এই ধরণিকে ভালোবাসতে চায়। এই ধরণিকে ভালোবেসে বাঁচতে চায়।
বর্ষার রাতে চটানে ফিরে গেরু দেখল, শনিয়া মাচানে পড়ে আছে। শনিয়ার চোখ দুটো ছলছল করছে। গেরুকে অপলক দেখছে শনিয়া। ভুখা থেকে শনিয়া বুঝি কথা বলতে পারছে না।
শনিয়ার চোখ দুটো দেখে গেরুর খুব কষ্ট হতে থাকে। ভুখা থেকে মেয়েটা বুঝি মরে যাবে—তবু চটান ছেড়ে যাবে না। চোখ দুটো শনিয়ার এমন ভাবই প্রকাশ করে। গেরু শনিয়ার পাশে বসে। অথচ কিছু বলতে পারে না। আদর অথবা কোনো সোহাগের কথা বলতে পারল না। এ সময় শনিয়াকে কী বলা যায়। কী বললে শনিয়া সুখ পাবে—সে ভেবে পেল না। অথচ শনিয়া গেরুর হাত টেনে বুকের কাছে রাখল এবং ইশারা করে একটু ঘন হয়ে বসতে বলল। গেরু ঘন হয়ে বসল এবং শনিয়ার ঠোঁট নড়তে দেখে বলল, তু কিছু বুলবি?
শনিয়া হাসল। ঠোঁট দুটো বেত পাতার মতো কাঁপছে। পাতলা ঠোঁটে অল্প হাসিটুকু গেরুর খুব ভালো লাগছে।
শনিয়া বলল, তু কেবল বাইরে বাইরে থাকিস। তু হামারে দেখবি না?
গেরু বলল, জরুর দেখব। লেকিন তুকে কিছু খেতে দিতে পারছি না, বহুত কষ্ট হামার।
কোনো কষ্ট না আছে। তু আয়, কথা শোন।
গেরু নিজের মুখটা শনিয়ার ওপর নামিয়ে দিল।
শনিয়া ফিসফিস করে বলল, হামার পেটে তুর একটা বাচ্চা এয়েছে গেরু। বহুত সুখের কথা বাচ্চাটা তুকে বাপ ডাকবে, হামারে মায়ী ডাকবে। বলতে বলতে শনিয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গেরুরে গেরু, তু আচ্ছা হো যা। হামি ভালো হয়ে উঠব। হামি কাজ করবে তু কাজ করবে। একটা বাচ্চার কৈ দুখ না থাকবে।
গেরু আনন্দে অধীর। ইচ্ছা হয় সকলকে ডেকে বলে, হামভি চটানে মরদ বনে গিলাম। কিন্তু রাত বলে, সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে, সে শনিয়াকে কাঁধে ফেলে ঘুরতে থাকল। কয়েকটা পাক খেল ঘরে, শনিয়া চিৎকার করছে গেরু হেরে তু করছিস কি! খুশির চোটে তু কী হামারে মেরে ফেলবি!
গেরু শনিয়াকে মাচানে শুইয়ে দিল। দু দণ্ড পাশে শুয়ে থাকল। তারপর সে শনিয়াকে মাচানে রেখে শহরের দিকে চলে যাওয়ার আগে বলল, তু ঘুম যাস না। হামি আ—ভি ফিরে আসবে।
সারা রাত ঘুরে শহরের কোনো ঘরে, কোথাও সে চুরি করতে পারল না। ভোর রাতের দিকে সে ফিরে এল। সে দেখল মাচানে তখন শনিয়া জেগে আছে। সে বললে, না—রে কিছু হল না।
শনিয়া মাচানের নিচে থেকে একটা থালা বের করে দেয়। তু খা লে। নেলি হামারে একথাল, তুরে একথাল দিয়ে গেল।
গেরু খেতে খেতে বলল হামার ভি একটা বাচ্চা হবে। হামার ভি ঘর হবে। লেকিন অভাব হামার যাবে না শনিয়া। একটা জীয়ন হাড় না হলে তু মরবি, হামি মরবে, বাচ্চাটা ভি মরবে। একটা বেহ্ম চণ্ডালের হাড় হামার জরুর লাগে। গেরু এ সময় হারুর বিবর্ণ মুখটা দেখতে গেল।
তখন ঘাটোয়ারিবাবু কালো রঙের চেয়ারে বসে জানালার গরাদে নিরবধিকালের মুহূর্তকে প্রত্যক্ষ করলেন। দূরে কে যেন কালের ঘণ্টা বাজায়! সবই প্রত্যক্ষ করলেন এবং ভাবলেন—বিস্বাদ, বিস্বাদ শুধু। শুধু যন্ত্রণা, শুধু মৃত্যু, শুধু বিষণ্ণতা। ভিন্ন ভিন্ন সব যন্ত্রণার প্রহসন। বরং কোথাও চলে যাওয়া ভালো। মৃত্যুর প্রহসনে, যন্ত্রণার রাজ্যে বেঁচে সুখ নেই। যত নেলির ছেলে বড় হচ্ছে, যত দুঃখবাবু চটানে এসে ছেলের দুষ্টুমির গল্প করছেন তত ঘাটোয়ারিবাবু এই সব ভেবে অধীর হচ্ছেন। আর ভাবছেন দূরে কালের ঘণ্টা কে যেন বাজায়!
পাখিরা আকাশে নেই। পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দুটো কাক মরে পড়ে আছে। দুটো দোয়েল আকন্দ গাছটার ছায়ায় বসে জানালার গরাদে ঘাটোয়ারিবাবুকে দেখছে। ওর চোখ, মুখ দেখছে। ঘাটোয়ারিবাবু জানালায় কেমন পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বর্ষার নদী দেখছেন। নদীটা চটানের পোয়াতী বৌদের মতো কলকল করছে। দোয়েল দুটো এখন শিস দিচ্ছে। নেলির ছেলেটার বয়স বাড়ছে। অফিস বারান্দায় হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে জানালায় উঁকি দিচ্ছে। হাত—পা নেড়ে কত রকমের কথা বলছে। বড় বড় চোখ হয়েছে বাচ্চাটার। নাক, চোখ, মুখ নেলির মতো। মুখের গড়নটা, শরীরটা, দুঃখবাবুর মতো। ঘাটোয়ারিবাবু এ সময় কিঞ্চিৎ হাসলেন। ব্রাহ্মণের ঔরসে চণ্ডালিনীর গর্ভে সন্তান—কৈলাস হলে বলত, বেম্ম চণ্ডালের ছা। তিনি কিঞ্চিৎ হাসলেন। তেমন ছা থেকেই রাহু চণ্ডালের হাড় হয়। শুধু হাড়টার ওপর এক রোজের পুজো আর্চা কালীর থানে মানত। বাচ্চাটাকে জলের নিচে চুবিয়ে মারা এবং রাতে শ্মশানকালীর পুজো। যখন কৈলাস প্রথম এল চটানে, যখন সে হেকিমি করত কোর্টে, তখন সে বলত, বাবু ও বড় লাখোটিয়া চীজ আছে। এ সহজে মিলবে না বাবু। ওস্তাদ রসিদ বহুত কসরত করে পেরাগের থেকে একটা বেম্ম চণ্ডালের ছা চুরি করেছিল। তারপর বহুত তন্তর—মন্তর তারপর বাচ্চাটাকে জলে শ্বাস বন্ধ করে মারা। বলতে বলতে কৈলাস কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত। ঘাটোয়ারিবাবু এখনও যেন তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। যেন কৈলাস ওর পিছনে দাঁড়িয়ে এইমাত্র কথাগুলো বলে গেল। হাড়টা চুরি যাবার পরও কৈলাস কতবার এসেছে বাবুর কাছে। বসেছে, বলেছে, একটা হাড় লাগে বাবু। লেকিন কাঁহা মিলে! কাঁহা মিলে! নেলির বাচ্চাটাকে দেখে বাবুর মনে হল কৈলাসের প্রেতাত্মা যেন ওর চারপাশে ঘুরছে। ওর শরীর থেকে হাড় বের করে নেওয়ার জন্য দিনরাত সেই প্রেতাত্মার চোখে ঘুম আসছে না। প্রেতাত্মা চটানের চার পাশটায় ঘুরছে ফিরছে। ফাঁক খুঁজছে চুরি করবার জন্য।