অথচ ভোর হলে রাতের ভাবনাটা আর থাকে না। শরীরটা হালকা লাগে। মন মেজাজ দুই—ই তখন প্রসন্ন। তখন মনে হয় কী দরকার এভাবে বেঁচে। এবং ফের ফরাসডাঙায় যাবে অথবা ঝুমঝুমখালিতে—কঙ্কাল খুঁজে খুঁজে বেড়াবে। দুটো পেটের দায়ে একটা খুনখারাপির দিকে টেনে নিয়ে যাবে? মনে মনে সে সত্যি তা চাইল না।
সে ভোরে উঠল। গামছাটা কাঁধে ফেললে। বাবুচাঁদ শুয়োর নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন ভরা গাঙ। চটান থেকে বর্ষার জলে নৌকা দেখা যাচ্ছে। পাল দেখা যাচ্ছে। মাস্তুলের ডগায় দু—একটা পাখি বসে আছে। সূর্যের গাঢ় রঙ নদীতে—শ্মশান চটানের খুব কাছাকাছি এখন। এ ভোরে এই সব দেখে বাচ্চাটাকে দেখার ইচ্ছা গেরুর প্রকট হয়ে উঠল। সে বাইরে থেকে ডাকে, চাচা ঘুম থেকে উঠলি? ভিতরে ঢুকে গেল সে। বাচ্চাটা নেলির পাশে বসে খেলছে। নেলি ঘুমোচ্ছে। গেরুকে দেখেই ওঠার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দিল। গেরু তখন কথা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে কোলে নেবে না। রাগে দুঃখে অভিমানে নেলির চুল ধরে টানে বাচ্চাটা। নেলি ঘুমের ভিতরই বলল, বাপ, তু হামারে জ্বালাসনে। থোড়া ঘুম যেতে দে। এই ঘুমের ভিতর নেলি যেন কত বছর আগে চলে গেছে। গেরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ভারী মজা পায়।….শনিয়া যদি এমন একটা বাচ্চা দে লিত চটানে।
গেরু বলল, চল হারুয়া, গঙ্গার ধারে চল। নেলির দিকে চেয়ে বলল, হামি হারুয়াকে লিলামরে নেলি।
আজ গেরু কোর্ট—কাছারি করতে গেল না। যা আছে তাতে ওরা দু—পাঁচ দিন খেতে পারবে। কাছারিতে গেলেই এখন শমনের মতো লোকগুলো ওর চারপাশে জড়ো হতে থাকে। অপমান করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। গেরু দুটো কথা বলতে উঠলে ওরা বলে ধোঁকাবাজ। গেরু বাপের মতো কসরত দেখিয়ে যখন সমস্ত জনতাকে বশ করে আনে তখন হয়তো একটিমাত্র লোক বলে ওঠে, এ সব মাদুলি—ফাদুলিতে কোনো কাজ হয় না। সোয়া পাঁচ আনা পয়সাই জলে। গেরু তবু থামে না। লোকটার কথা পরোয়া করছে না। এমনি ভাব ওর চোখে—মুখে। সে নাচে, লাফায়। সে বলে বিশ্বাসে আশ্বাস বাবু। দশজনের কথায় কান দেবেন না। নিজের শরীরে ধারণ করে লেন। পরখ করেন। বিশ্বাসে আশ্বাস বাবু। বিশ্বাসে আশ্বাস।
কিন্তু ঐ একটিমাত্র লোকই ওর ব্যবসায় ক্ষতির পক্ষে যথেষ্ট। লোকগুলো ওর নাচন—কোঁদন দেখে মাত্র। তামাশা দেখে মাত্র। নাচন—কোঁদন থেমে গেলেই ওরা ধীরে ধীরে সরে পড়ে। মনে হয় এতক্ষণ ওরা ওর কেরামতি দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলে, শালারা! একটা জীয়ন হাড় লাইরে! তবে তুগো সমঝে দিতে পারতাম হাকিমি দানরি বুলে কাকে!
গেরু গঙ্গার ধারে হারুকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এমনি সব কথা ভাবে।
বর্ষার গঙ্গা বলে সে নিচে নামতে পারল না। এক মাল্লা, দু মাল্লা—সব নৌকাগুলো ঘাটে ঘাটে ভিড়ছে। ফজলি আমের নৌকা। কাঁঠালের নৌকা। গেরু হারুকে নিয়ে নৌকার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আম কাঁঠালের গন্ধ নাকে আসে। দুটো একটা পাখি ওড়ে নদীর জলে। ওদের ছায়া পড়ে না। জল ঘোলা। জলে ঘূর্ণি। ঘূর্ণিতে একটা গোবরে পোকা ডুবছে। পোকাটাকে ডুবতে দেখে গেরুর কেমন কষ্ট হতে থাকে।
হারুর দিকে চেয়ে বললে গেরু, কিরে সাঁতার দিয়ে লিবি? তুর মায়ী ত সাঁতারে গঙ্গা পার হত।
হারু দুটো হাত একসঙ্গে করে নাড়তে লাগল। পু…পু করতে থাকল। যেন গেরুর কথা সে কত বুঝতে পেরেছে।
গেরু খুশি হয়ে হারুকে দু হাতের ওপর নাচাল। মাথার ওপর ঘোরাল। তারপর গালটা গালে ঘষে দিয়ে খুব জোরে দু’টো চুমু খেল। —আঃ। অদ্ভুত সে একটি শব্দ তুলল গলায়।
জল নামছে নিচে। ঘূর্ণি উঠছে। ঘোলা জল। অন্যপারে একটা ধস পড়ার শব্দ হয়। গেরু দেখে ধসটা একটা অতিকার কচ্ছপের মতো যেন নদীর গর্তে নেমে গেল। হারু ওর কোলে। হারু নিচে নামতে চাইছে। নিচে নেমে দুষ্টুমি করতে চাইছে। গেরু ওকে দুষ্টুমি করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই যেন নিচে নামিয়ে দিল। হারু তখন হামাগুড়ি দিচ্ছে, হারু তখন ছুটছে। গেরু যত ওকে ধরার জন্য ছুটছে, সেও তত চুটছে এবং হামাগুড়ি দিচ্ছে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে। গেরু অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে ছুটাছুটি করল। অনেকক্ষণ হাসল। অনেকক্ষণ ওরা দুজনে নদীর পাড়ে, নদীর হাওয়ায় নদীর জলে পুলকিত হল। তারপর একসময় ওরা নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে থাকে। নদীর জল দেখে, ঘূর্ণি দেখে। ধস নামা দেখে। গুণ টানা নৌকায় ছইয়ের ওপর মাঝিদের গান শোনে। গেরু এবং সে এই সব দেখে আপাতত মশগুল হয়ে থাকে।
গেরু হারুকে নিয়ে বেশ মশগুল হয়েছিল। অনেকদিন হারুকে কাঁধে করে নদীর পাড়ে পাড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বর্ষার ভরা গাঙে দু—পা ডুবিয়ে বসেছে। এখন দুটো একটা কথা বলতে পারছে হারু। গেরুর হাতে পায়ে ভর করে ধরে কাঁধে উঠবার চেষ্টা করত হারু। কত রকমের কথা বলত। সে পাখি দেখলে বলত, গেউ….চাচা….পাখ….ই….। গেউ চাচা ফস—দাঙ্গা যাবে। গে…উ চা…চা…ল…দি…য় পা…নি…খাব…অ…।
গেরু চুপচাপ বসে থাকে। জলের ধারে ওর ছায়া পড়ে তখন। হারু কথা বলে—রাজ্যের কথা। গেরুর খুব ভালো লাগে। অভাবের যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারছে। নদীর অন্য পারে সানাই বাজে। বাবুদের বাড়ি বিয়ে। বাপ ওর বিয়ে দিয়েছিল! বিবি ওর এখনও চটানে আছে। কোনদিন চটানে ছেড়ে ভাগবে। কোনদিন বলবে, তুর লাখান মরদ হামার লাগে না। আমি অন্য চটানে উঠে যাবে। গেরু যেন সেই ভয়ে চটানে বেশিক্ষণ থাকে না। যতক্ষণ পারে চটানের বাইরে কাটিয়ে সাঁঝ লাগলে চটানে উঠে যায়। কখন জানি বলবে মেয়েটা, চললাম রে মরদ। কখন জানি বলবে মেয়েটা—হামার মরদ বটে তু। দুটো পেটের দানা চটানে তুলতে লারিস। সাঁঝ লাগলে চটানে উঠত গেরু, কিন্তু শনিয়ার সঙ্গে কথা না বলে মাচানে উঠে শুয়ে পড়ত।