বহুত আচ্ছা।
তুর একটা মাদলি কিনতে শখ গেল না?
জরুর শখ গেল।
ও হামি আচ্ছা বলিয়ে লিচ্ছি। পয়সা, পয়সা, কত পয়সা হবেক দেখবি।
একদিন, দুদিন, তিনদিন রসল্লা দিল গেরু। তিনদিনই দরজায় দাঁড়িয়ে শনিয়া দেখল সব। তিন দিন শাগরেদের মতো গেরুকে সাহায্য করেছে। গাছগাছালি বিছিয়েছে। গাছগাছালি চাদর থেকে তুলে ধরে রেখেছে। তিনদিনই মনে হয়েছে—গেরু অন্য মানুষ। গেরু দানরি হয়ে গেছে কিংবা হাকিমদার।
পরদিন ভোরে মাথায় কাঠের বাক্স নিয়ে হাতে হারিকেন নিয়ে চটান থেকে নেমে গেল গেরু। শিবমন্দিরের পথ ধরে সে শহরের রাস্তায় পড়ল। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। সে লোক ঠেলে যেতে লাগল। কোর্ট—কাছারি করতে যাচ্ছে। সুতরাং বাপের কথাগুলো আওড়াচ্ছে মনে মনে। সে রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটে। মোটর রিকশা বাঁচিয়ে হাঁটে। একদিন, দুদিন এবং অনেকদিন হাঁটল। কোর্ট—কাছারিতে বসল। অনেকদিন। বাপের মতো জোর গলায় কথা বলেছে অনেকদিন। বাপের মতো অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চাদরের ওপর জড়িবুটি বিছিয়ে নেচেছে, কুঁদেছে। অথচ বিক্রি ভালো হয়নি। এত করেও বাপের মতো বিক্রি তুলতে পারছে না, মাদুলি বিক্রি হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ আসেনি। মামলা—মোকদ্দমায় হেরে গিয়ে ওকে এসে ধরেছে। বলেছে, জুয়াচোর। কেউ কেউ গালমন্দ করেছে। মারধোর করেছে। ওর তখন ভয়ানক আপশোশ। জিয়ন হাড় বাদে সব তাবিজ—ওবিজ বে ফয়দা। সে নিজেই যেন নিজের নসিবকে ঠকাচ্ছে। রাহু চণ্ডালের হাড় না হলে গাছগাছালির দ্রব্যগুণ ফাঁকা মাঠে ঘোড়দৌড়ের মতো। সবই হবে—শুধু কাজ দেবে না। শুধু গালমন্দ জুটবে। সে এখন যেন মনে মনে বাপকে খুঁজছে। ডোমন সাকে খুঁজছে। মনে মনে বাপের কথা আওড়াচ্ছে। হাকিমি বলিস, দানরি বলিস, এ চীজ বেইমান মানুষের দু—দশ দফে কাজে লাগে। আউর শালা শুনে লে, রাহু চণ্ডালের হাড় লাগে, তুরা যাকে বলিস জীয়ন হাড় কিংবা ব্রেহ্ম চণ্ডালের হাড়। দানরি—ফানরিতে হাড়টাই সব।
নেলির বাচ্চা এতদিনে হামাগুড়ি দিচ্ছে চটানে। হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যাচ্ছে। অঃ…অঃ…করে কথা বলছে। কাক তাড়াচ্ছে। মাছি, ব্যাঙ তাড়াচ্ছে। হেঁটে হেঁটে ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে চলে যাচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবুর পায়ের কাছে বসে সারাদিন খেলছে। ঘাটোয়ারিবাবুও কথা বলছেন ওর সঙ্গে। ঘাটোয়ারিবাবুও অঃ অঃ করছেন। হাত নেড়ে, চোখ বড় করে, পু পু করে কথা বলছেন, খেলছেন সারাদিন। তিনি এখন বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাটাকে নিয়ে মন্দ কাটছে না।
গঙ্গা—যমুনা সঙ্গে এখন যাচ্ছে না। ওরা চটানে বাচ্চাটার পাহারায় থাকছে।
অশ্বত্থ গাছের শেষ পাতাটা থেকে যখন সূর্যের রঙ সরে যায়, গেরু ওর পুঁটুলি বেঁধে কাঠের বাক্স মাথায় নিয়ে পাশের দোকানিকে বলে, দাও ত দেখি, এবার তবে উঠতে পারি।
দোকানি এক পয়সার একটা বিস্কুট দিল। গেরু বিস্কুটটা একটুকরো কাগজে মুড়ে সযত্নে পকেটে রাখে, তারপর হারিকেন জ্বালিয়ে শহর ধরে গঙ্গায় নেমে যায়। চটানটা দেখলেই নেলির বাচ্চার কথা মনে হয়। বাচ্চাটাকে একটা বিস্কুট খাওয়াতে পারলে খুশি হয় সে। চটানে উঠে গেরু ডাকল, চাচা হামার কাঁহারে? চাচা।
নেলি যেদিন সকাল সকাল গাওয়াল করে ফেরে, সেদিন বাচ্চাটা ওর কোল থেকেই অঃ…অঃ….করে উঠবে। দুহাত নাড়বে। কল—কল করে উঠবে। যেদিন ফিরবে না, সেদিন হয় দুঃখবাবুর ঘরে, নয় ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে থাকবে। গেরুর গলার আওয়াজ পেলেই জানালা দিয়ে উঁকি দেবে। শব্দ পেয়ে গেরু জানালায় দাঁড়াবে। আলোটা তুলে ধরে বলবে, চাচা খা লে।
তখন ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারে বসে চোখ বুজে থাকেন। চোখ বুজেই বলেন, গেরু এলি?
হে বাবু, এলাম।
ব্যবসা তোর চলছে কেমন?
আচ্ছা না বাবু। আচ্ছা না চলছে। তারপর ধীরে ধীরে গেরু জানালা থেকে মুখটা নামিয়ে নেয়। ব্যবসা জমে উঠছে না। মন ভারী হয়ে উঠেছে দিন দিন। দিন দিন কেবল বাপকে মনে পড়ছে আর রাহু চণ্ডালের হাড়ের কথা ভাবছে সে। এ সব ভেবে চটানে উঠে যেতে থাকে। এ সময় শনিয়া আসে। গেরুর মাথা থেকে কাঠের বাক্স নামাতে সাহায্য করে। হাত—মুখ ধোয়ার জল রাখে দাওয়ায়। ঘরে ঢুকে মাচানে বসে গেরু বলে, রাহু চণ্ডালের হাড় না হলে আর চলছে না বৌ। বাদী—বিবাদীরা রোজ বচসা করছে। মাদুলি কেউ লিচ্ছে না। সবাই বলছে আমি ধোঁকা দিয়ে পয়সা লিচ্ছে।
তু খেয়ে লে ত। তা হবেক পরে হবে।
খেতে খেতে গেরু বলল, নেলি ফেরেনি?
না।
নেলির ব্যবসাও আচ্ছা যাচ্ছে না বুল।
হামি কী করে বলব?
শনিয়া একটু পচাই ঢেলে বলল, লে, খা লে। শনিয়া জানে এই পচাইটুকুর বিনিময়ে গেরু চটানের সব দুঃখের কথা ভুলে যাবে। তখন ওর মনে হবে দুনিয়ায় বেঁচে সুখ আছে! দুনিয়াকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট।
সব পচাইটুকু শেষ করে গেরু ঝিম মেরে বসে রইল। শনিয়া ওর হাত মুখ ধুয়ে দিয়ে মাচানে তুলে দিল। গেরু মাচানে বসে ঝিমায়। চার্চের ঘড়িতে তখন কে ঘণ্টা পেটাচ্ছে। তখন নেলি নিজের ঘরে বসে আদর করছে বাচ্চাটাকে। ঘাটোয়ারিবাবু সুর করে মহাভারত পড়ছেন। কেউ বচসা করছে ঝাড়োর সঙ্গে। ওদের উনুনে আজ হাঁড়ি চড়েনি। বচসাতে সে সব ধরতে পারছে। দু’চারদিন পরে এ ঘরেও হাঁড়ি চড়বে না। বিক্রি খুবই কমেছে। নেই বললেই চলে। দুটো পেটের দায় ওকে পীড়িত করতে থাকল। হাড় সংগ্রহের জন্য নানাভাবে চিন্তায় ডুবে যেতে থাকে। গেরু নিষ্ঠুর হতে চাইছে, বীভৎস হতে চাইছে। সে বাপকে মনে করতে পারছে। রসিদের দরগা, কালীর থান এবং অনেক বীভৎস গল্প যা বাপের কাছে শুনেছে—সব মনে করতে পারছে। গেরু একটা মদের ঢেকুর তুলল। পাশের ঘরে এখনও পু পু করছে….বাচ্চাটা। ওর লোভ বাড়ছে। গেরু নিষ্ঠুর হতে চাইল। বীভৎস হতে চাইল। বাচ্চাটা কখন ঘুমোবে! নেলি কখন ঘুমোবে। গঙ্গা—যমুনা কখন নদীর ঢালুতে নামবে। কখন নেমে যায়? কখন ঘাটোয়ারিবাবু জেগে থাকবেন না—কখন, কখন এমন সব ঘটবে। সে মাচানে বসে অধীর হয়ে উঠল। মনে মনে সে ভারী নিষ্ঠুর। মায়া দয়া নেই এবং মমতাহীন। নেলির বাচ্চাটাকে সে রাতের আঁধারে চুরি করে খুন করতে চায়। খুন করে হাড় সংগ্রহ করতে চায়।