দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়িয়ে এ সবও শুনলেন।
জল গরম করে হরীতকী নেলির ঘরে ঢুকল।
একটা শুকনো কাঠের গুঁড়ি গেরু এবং শনিয়া দুজনে মিলে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে গেল।
নেলি মাচানে এ—পাশ ও—পাশ করছে। উঠছে—বসছে, গাভীন গোরুর মতো হামলাচ্ছে। মুখ, শরীর শক্ত করে দিচ্ছে।
হরীতকী বুঝল খুব কষ্ট হচ্ছে নেলির। বাচ্চাটা হতে কষ্ট দিচ্ছে নেলিকে। হরীতকী সহ্য করতে না পেরে বাইরে এসে দাঁড়াল। গেরুকে ডেকে বলল, তুর বাপ তো দানরি—ফানরি করত। খুঁজে দেখ না দুচারঠো চিজ মিলে কিনা! তুর বাপ তো পোয়াতির বাচ্চা আনতে জেরা সময় লিত। খুঁজে দেখ না ময়রুন বিবির ফল তুর ঘরে আছে কিনা। নেলি বহুত কষ্ট পেয়ে লিচ্ছে। পেলে ওয়াকে ডুবায়ে দিতাম পানিতে। পানি খাইয়ে দিলে ও—মেয়েটা আসান পেত।
চটানে দাঁড়িয়ে গেরু হঠাৎ বাপের হেকিমি জীবনটার কথা মনে করতে পারল। মনে হল ওর—এইত সময়। কঙ্কালের দাম কমে যাচ্ছে। মড়ক আর লাগছে না। হিল্টন কোম্পানির বড়বাবু কঙ্কাল কিনছেন না। এই ঠিক সময় বাপের ব্যবসাটা জোড়াতালি দিয়ে ফের আরম্ভ করে দেওয়া যায়। সে তাড়াতাড়ি বাপের মাচানের নিচে ঢুকে গেল। হাতড়ে হাতড়ে ছোট বড় অনেক মেটে কলসি, হাঁড়ি বের করল। বেড়ার পাশ থেকে বেতের ঝুড়িটা টেনে বের করল। ঝুড়িটা ইঁদুরে খেয়েছে। উইপোকরা কেটেছে। মাকড়সার জাল ঝুল কালিতে ভরে আছে। সে ঝুড়িটা তুলে বাইরে নিয়ে এল।
এখনও দুটো একটা প্রায় সব রকমের গাছগাছড়াই আছে যেন। হেমতাল কাঠ আছে, নরসিং ঝাঁপ আছে। বন রুই মাছের ছাল আছে। শ্বেতশিমুলের ছাল, গোঁড়ের ছাল আছে দুটো। নীল বানরের মাথা আছে। গেরু তন্ন তন্ন করে করে খুঁজছে। আছে, আছে, যেন সব আছে। সে নিচে ময়রুন বিবির ফুল পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, পিসি আছে রে আছে। পেয়ে লিছিরে ময়রুন বিবিরে। দে দে জল খাইয়ে দে। ওরে শনিয়া, জলদি পানি লিয়ে যায়। ময়রুন বিবিরে ডুবায়ে দে। পানিটা খাইয়ে দে পোয়াতিরে, বাচ্চা হতে জেরা সময় লেবে। ঠিক বাপের মতো গেরু সুর করে কথাগুলো বলতে থাকল।
পরদিন ভোরবেলায় গেরু দাওয়ায় একটা চাদর বিছিয়ে সব গাছগাছালিগুলো রাখল। ফুঁ দিয়ে ধুলো সাফ করল। সরু একটা কঞ্চি কেটে, বাপের মতো কঞ্চিটা হাতে নিয়ে চাদরের চারপাশে ঘুরতে থাকল। গেরু চাদরটার চারপাশে নাচল কুঁদল। লাফাল। বাপের মতো ঘুরে ফিরে নেচে—কুঁদে রসল্লা দিচ্ছে। যেন কোনো ভুল না হয়। যেন আনাড়ি বলে লোকে ধরতে না পারে। সে ঘুরে ঘুরে বাপের কথাগুলো মুখস্থ করল। কোর্ট—কাছারিতে হেকেমি করার সময় বাপ যেমন চেঁচাত, সেও তেমনি চেঁচাতে থাকল। এ পুন্ন—পদের মাদুলি। এ ঝাড়ফুঁক লয়, এ জাদু মন্তর লয়, এ আছে জড়িবুটির কারবার—দ্রব্যগুণ। ডান পুকুস টান মারে, তোষক করে, পির পরিতে নজর দেয় বাণ মারে, এ মাদুলি দেহে লিলে আসান পাবে দেহ। বহুত সামান্য দাম আছে লিয়ে যান। বিবি বুঢঢার লাগি লিয়ে যান। গেরু বাপের মতোই সুর করে কথা বলল।
শনিয়া বলল, এবেনে এটা কী হচ্ছে?
গেরু বিরক্ত হয়ে বলল, এবেনে এটা কাম হচ্ছে। এবেনে তু কাজিয়া না করবি। খাওয়ান থাওয়ান মাত করবি। হামি হাড়—গোড়ের ব্যবসা করবে না। হাকিমি ব্যবসা করবে। দু চারঠো গাছগাছালি জোগাড় করে লিলেই হবে। তু থাম।
শনিয়া গেরুর চোখ দুটো দেখে ভয় পেল। সে কিছু বলল না। চুপচাপ দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। গেরুর লাফ ঝাঁপ দেখল, এবং ফিক করে হেসে দিল এক সময়। গেরু এখন অজগর সাপের মতো হয়ে যাচ্ছে। সে বলছে—ডিহিবড়া সাপের চোয়াল গা। গেরু ডিহিবড়া সাপের মতো মুখ করে হাই তুলছে। শনিয়া ওর হাই তোলা মুখের ঢঙ দেখেই হাসল।
গেরু রুখে উঠল, তু হাসলি কেনে?
হামি হাসলাম কুথি আবার?
তু হাসলি না, ফিক করে হাসলি না তু?
তু অমন করছিস ক্যানে? মুখটাকে সাপের মতো করে হাই তুলছিস।
হাই তুলবো না। সাপের কথা তুললে সাপের মতো হতে হয়। বানরের কথা তুললে বানরের মতো হতে হয়। তবে দানরি—ফানরি হবে। কাজ কারবার হবে। এটা তামাশা ভেবে লিস না শনিয়া। এ বহুত তন্তর মন্তরের কারবার আছে। তু মত হাসবি। ঠিক এখানটাতে বসেই বাপ হামাকে গাছগাছালির নাম শেখাত। বাপ বুলত। শিখে লে বেটা। এ কাম করে খেতে পারলে চটানে ভুখা থাকতে হবে না। শনিয়ার দিকে মুখ তুলে ফের বলল, তু—হাসবি না।
হাসব না।
গেরু বাপের মতো রসল্লা দিতে লাগল আবার। সে ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। যেখানে যেমন যে বলছে, সেখানে সে তেমনটি হওয়ার চেষ্টা করছে। বাঘের কথা বলছে বলে বাঘের মতো হাঁটছে। সে বলছে—সুন্দরবইনা বাঘ। বাবুরা বলেন রুয়েল বেঙ্গল টাইগর। নীল বানরের মাথা, বনমানুষের হাড়, কুল কুহলীর গাছ। মরদ রাজের মূলে ছ দফের রেণু মিলে কবচ দিলে নাম তার মহাশক্তি কবচ বাণ। গুণ বহুত পেকারের। যে আদমী বিছানা খারাপ করে, আস্বপ্ন—কুস্বপ্ন দেখে, যার বাদী দুশমন শত্রু আছে—বাণ মারে, বন্ধন করে—তার লাগি এই কবচ বাণ। বড় সামান্য দাম আছে। —মাত্তর স পাঁচ আনা। খুব বেশি দাম লয়। ঘাটে পথে দোকানে দুশমনে কত পয়সা যায়—মাত্তর স পাঁচ আনা। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে এবং লাফালাফি করে গেরু অবসন্ন হয়ে পড়ল যেন। সে বসল কালো চাদরটার পাশে। তারপর শনিয়ার দিকে চেয়ে বলল, কেমন শুনলি বল।