কি বুলব বাবু?
লোকে তোকে বলে না বাচ্চাটা পেটে কী করে এল?
বুলে!
তুই কী বলিস?
বুলি বাচ্চাটা ভগমান দিল। ও হামার ভগমান আছে।
দুঃখবাবু এবার কাঁদো—কাঁদো হয়ে বললেন, আমার কথা বলিস—নি তো?
পাগল। তা হামি বুলি! কভি বুলবে না। বাবু হাম তেরে সাধ বেইমানি না করবে। লেকিন বাবু ওরা ত মরদ আছে। ওরা কী জানে না। ওরা কী টের পায় না বলছিস? লেকিন হামি কিছু বুলবে না বাবু। হামি বেইমানি করবে না। তু হামার ভগমান আছে।
দুঃখবাবু এবার বললেন, তাহলে তুই যা। এই কথা থাকল।
তখন গেরু নিজের ঘরে বসে হল্লা করচে। কৈলাস মরে যাওয়ার পর থেকেই ওর ঘরে ফের অভাব ঢুকল। অভাবের জন্য সে কৈলাসকে ফরাসডাঙায় টেনে নিয়ে গেছিল। সেখান পুঁতে কঙ্কালটা সংগ্রহ করেছিল এবং অল্প দামে বিক্রি করেছিল হিল্টন কোম্পানির বড়বাবুর কাছে।
বড়বাবু ওকে শুধিয়েছিলেন, তোর নাম কী রে?
গেরু ডোম।
বাপের নাম কী?
কৈলাস ডোম।
হ্যাঁরে তুই কৈলাসের ছা। কৈলাস মরদ ছিল বটে।
জী বাবু।
কটা কঙ্কাল এনেছিস?
দুটো।
একটা পুরুষমানুষের বাবু। একটা মেয়েমানুষের। একটা বাপের, অন্যটা ফরাসডাঙায় পোঁতা।
বড়বাবু বিদ্রূপ করে বললেন, বল মায়ের। বাপেরটা দিয়েছিস, মায়েরটা দিতে ক্ষতি কি!
গেরু দাওয়ায় বসে হল্লা করছে। বলছিল, আসুক টিকায়ালা মাগিরা। ওয়াদের গঙ্গার পানিতে চুবিয়ে না লিচ্ছিতো হামার নাম গেরু লয়। দ্যাশে আর মড়ক লাইক। নেলি দেখল কৈলাস মরতে না মরতে গেরু বাপের মতো হয়ে উঠল। বাপের মতো টেনে টেনে কথা বলছে। বাপের মতো আপশোশ করতে শিখছে। শনিয়া পাশে বসে গেরুর গালমন্দ শুনছে। ঝাড়োর ঘরে বচসা হচ্ছে তখন। লখি, টুনুয়া, চাকু নিয়ে মারামারি করছে। লখির হাত থেকে এখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। ঝাড়োর বৌ এবং ঝাড়ো মিলে দুজনকে দুঘরে আটকে রাখল। নতুবা যেন তক্ষুনি চটানে একটা খুনোখুনি হত।
নেলি ভাত রাঁধছিল। ওদের হৈ—হল্লায়, নাচন—কোঁদনে সে সেখান থেকে নড়ল না। লখি, টুনুয়া তো চোর। ছিঃ চুরি করে পয়সা কামাচ্ছিস! মুখে তুদের পোকা পড়ুক। উনুনে পোড়া কাঠ গুঁজে দেবার সময় সে শুনল, গেরু বলছে, শালারা ঘড়ি চুরি করে লিছে। ঘড়ি চুরি করে আভি খুনোখুনি করছে, ভাগের পয়সা টুনুয়ার কম হল। মর শালারা খুনোখুনি করে।
শনিয়া বলল, ঘরে বসে ওদের গাল দিলি তুর চলবেক?
ক্যানে চলবেক না!
দু’টো দানা মুখে দিবি না!
কি করি বুল। নেলিকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলল গেরু। গোমানি চাচার নোকরিটা ভি হামার জুটল না। ডাকদারবাবুকে ঘুষ দিয়ে নোকরিটা দুখিয়া নিল। সেই কবে ফরাসডাঙায়—তখন ফাল্গুন মাস,—একটা যাও ভি মিলল, তার দাম বড়বাবু ঠিক দিল না। বুলছে—এখন কী আর দাম আছে কঙ্কালের। কত আসছে, আমরা কিনতেই পারছি না ঠিক দাম দিয়ে। কঙ্কালের দাম কমছে তো কমছেই।
গেরুর রাগ এখন যেন সব শনিয়ার উপর—শনিয়া তু দানা দানা করবি না। তু মরবি, হাম ভি মরে। গেরু দুটো হাত নাচিয়ে শনিয়াকে যেন এক্ষুনি গলা টিপে ধরবে এমন ভাব করল।
অভাব—অনটনে গেরু মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। নেলি ঘরে বসে সব ধরতে পারল। নেলি ঘর থেকেই বলল, গেরু তু আয়। তুর বহু হামার ঘরে চারটো খাবে। তোরা আজ আমার মেহমান থাকলি।
কাটোয়া থেকে সেই লোকটা এসেছে। মংলির ঘরে বসে দর—দস্তুর করছে ছেঁড়া তোশক—বালিশের। ঘরে বসে ওরা যেন কী সব শলা—পরামর্শ করল। দুখিয়া নেই। পুলিশ এসে ডেকে নিয়ে গেছে। হরীতকীর ঘরে ওর মেয়েটা হাত—পা নেড়ে খেলছে। নেলি ভাত রান্না করতে করতে একবার পিসির ঘরে উঠে গেল। চঞ্চলাকে আদর করল। পিসি ঘরে নেই—নদীতে নাইতে গেছে। নেলি ভাবল, পিসিকেও আজ ওর ঘরে দুটো খেতে বলবে।
বিকেলের দিকে গুমট ভাব। আকাশের নীল রঙটা ক্রমশ কালো হচ্ছে। গরমে চটানের মেয়ে—মরদেরা হাঁসফাঁস করছে। নেলির শরীরটা ক্রমশ মোটা হয়ে উঠেছিল বলে সে দুটো পা বিছিয়ে চালা ঘরটার মেঝেতে বসেছিল। আকাশ দেখছিল মাঝে মাঝে। হয় বৃষ্টি হবে, নয় ঝড়। চালা ঘরটার ওপরে তোশক—কাঁথা নেই বললেই হয়। ঝড় হলে যা আছে সব উড়ে যাবে, আর জল হলে ঘরে থাকা দায় হবে। বাইরে জল হওয়ার আগে ঘরে জল পড়বে। নেলি এই সব ভেবে ভেবে খুব মুষড়ে পড়ছিল। একবার গেরুকে ডাকলে হয়। বললে হয়, হামার চালে দুচারটা ছেঁড়া তোশক—কাঁথা ফেলে দে। দড়ি দিয়ে বেঁধে দে। লয়তো এ ঘরে থাকা হামার বড় দায় হবে।
কাটোয়া থেকে যে লোকটা এসেছিল, ঝড়—জলের আভাস পেয়ে চটানে থাকতে চাইল সে। লোকটা এখন চটানটা ঘুরে ফিরে দেখছে। দুখিয়া এলে বারান্দায় বসবে সে। দুজনে মিলে এক ছিলিম গাঁজা খাবে। চটান দেখার সময় সে আকাশও দেখল। খুব জল ঝড় হবে। আকাশ দেখার সময় সে এ কথা বলল।
গেরু নেলির চালে বসে বলল, খুব জল ঝড়ে হোয়ে লিবে। দে দেখি আর কী আছে। ঘরের সব কাঁথা—বালিশ দিয়ে লে। সব বিছিয়ে দি। রশি দে, পুরানা যা আছে সব দে, বেঁইধে দি।
নেলি শীতের সব কাঁথা—কাপড় টেনে বের করল ঘর থেকে। বাপের কাঁথা—কাপড়, ওর নিজের কাঁথা—কাপড়—সব কাঁথা—কাপড় বের করল। শীত আসতে আসতে আবার সব ঘাট থেকে জোগাড় করে নিতে পারবে। শনিয়া এবং নেলি দুজনে মিলে তোশক—কাঁথা সব উপরে তুলে দিল। গেরু চালার ওপর বসে রশি দিয়ে বাতার সঙ্গে সব কাঁথা—কাপড় বেঁধে দিল।