দুঃখবাবু নেলির খুব ঘনিষ্ঠ হলেন। প্রকৃতই দুঃখবাবু এঘটনায় খুব অনুতপ্ত হয়েছেন। চটানে যত দেখেছেন নেলিকে, তত বেশি তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন। তত তিনি ভেবেছেন বাপ—মা মরা মেয়েটার প্রতি তিনি এমন লোভী না হলেই পারতেন। যত তিনি এই সব ঘটনা নিয়ে ভেবেছেন, তত তিনি মেয়েটার ভালো—মন্দের জন্য নিজেকে দায়ী করেছেন। দায়ী করতে গিয়ে এক সময় দেখলেন ভালোও বেসে ফেলেছেন। দুঃখবাবু বললেন, আমার খুব ইচ্ছা তোকে কিছু একটা করেদি। কিন্তু কিছুই পেরে উঠছি না রে। কথাটা চটানে কতদিন বলব ভাবলাম, কিন্তু হয়ে উঠল না। তোদের অন্য মরদেরা যদি কিছু ভাবে। এই যখন মাচানে পড়ে থাকতিস, তখনও বারবার ইচ্ছে হয়েছে তোর কাছে যেতে, একটু বসতে, একটু ভালোবাসতে—কিন্তু পারিনি।
এই সব কথা শুনে নেলি খুব খুশি হল। মা—বসুন্ধরা এখনও তবে ওর জন্যে একটি মরদ রেখেছে যে নেলিকে ভালোবাসে, যে নেলিকে পিয়ার করে। এই সব কথা শুনে নেলির পুরনো ভালোবাসাটা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ইচ্ছাটাও। নেলি দুঃখবাবুর মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, বাবু তু হামারে পিয়ার করিস? এ বাত সাচ বাত বাবু?
সাচ বাত নেলি। তোকে আমি পিয়ার করি। তোকে আমি ভালোবাসি। আঁধার রাতে নতুনবাবু ভালোবাসার জন্য মাতাল হয়ে উঠলেন।
আমি তুকে ভালোবাসি বাবু।
নেলি!
হা বাবু।
তোকে আমি কিছু দিতে পারছি না। ঘরে বৌ আছে, ছেলেপুলে আছে। ওদের পুষিয়ে আর কিছু বাঁচে না। তোকে কিছু দিতে পারি না।
সেজন্য কিছু ভাবিস না বাবু, হামি হামার বাচ্চার জন্য ঠিক সঞ্চয় করে লিচ্ছি।
তারপর ওরা দু—জন বসে আরও অনেক কথা বলল। পুরানো ইচ্ছাটা দুজনকেই মাঝে মাঝে বিব্রত করে মেরেছে। দুজনই পরস্পর ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। দুজনে দুজনকে সুখী করতে চেয়েছিল—কিন্তু দুজনেই পারেনি! ওরা যেন শপথ করেছে মনে মনে সুখ—দুঃখের দুনিয়ায় ছল—চাতুরী থাকতে নেই।
ওরা দুজনেই শেষে উঠে দাঁড়াল। নেলি আগে আগে চটানে উঠে গেল। দুঃখবাবু একটু ঘুরে চটানে উঠলেন। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললেন। জানালাটা খুলে দিলেন। জানালায় দাঁড়িয়ে আঁধারেও নেলির মুখটা দেখতে পেলেন। যেন আঁধারের গর্ভে নেলি ছুটছে। উদ্দাম, উন্মত্ত হয়ে ছুটেছে। অথবা ঋতুমতী ঘোড়ার মতো ছুটেছে। নেলি দুঃখবাবুকে দেখে যেন থামল। যেন বলল, পথ ছেড়ে দে। হামি ছুটবে।
দুঃখবাবু খুব শক্ত হাতে যেন ওকে ধরে রেখেছেন। যেন বলছেন এভাবে ছুটে তুই মরে যাবি। তোকে আমি মরতে দেব না। তোকে বাঁচতে হবে।
সে যেন বললে—কার জন্য বাঁচব বাবু?
আমার জন্য। দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়িয়ে আঁধারের গর্ভে এ সব দেখে চলেছেন।
তখন যেন দুঃখবাবু দেখল নেলি ওর পায়ের নিচে পড়ে কাঁদছে। যেন বলছে, বাবু এ শরীরের বড় যন্ত্রণা। এ শরীরের দুঃখ কাউকে দিতে পারছি না বাবু। তু—যদি এ যন্ত্রণা দুহাত পেতে নিস!
জানালায় দাঁড়িয়ে দুঃখবাবুর মনে হল তিনি প্রকৃতই নেলিকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন। মনে হল তাঁর স্ত্রীর প্রতি যে গভীর ভালোবাসা, নেলির প্রতিও সেই গভীর ভালোবাসা। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে আবেগে গলে গলে পড়ছেন। তিনি ভাবছেন—বাপ—মা—মরা এই মেয়েটার সুখ—দুঃখকে অস্বীকার করলে ভগবানের পৃথিবীতে বেইমানি করা হবে। রাতের আঁধারে তিনি ভাবলেন, কালই বলবে নেলিকে—বাচ্চাটার বাপ হতে সে রাজি আছে। বলবে, এজন্যে আমার নসিবে যা আছে তাই থাকল নেলি, তবু তোর নসিবকে নষ্ট হতে দেব না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দুঃখবাবু মনের অনুশোচনায় বড় কাতর হয়ে পড়লেন।
পরদিন ভোরে নেলি যথারীতি এল। দুঃখবাবুর ঘরদোর অনেকদিন পর পরিষ্কার করল। দুঃখবাবু কাঠগোলায় কাঠ মেপে তখন ঘরে ফিরছিলেন। নেলিকে দেখে বললেন, তুই আমার ঘরে বোস। একটা কথা আছে।
দুঃখবাবু ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে ঢুকে বললেন, ইমতাজ আলী ষাট মণ কাঠ দিয়ে গেল। টাকাটা কী আজই মিটিয়ে দেবেন, না ওদের কাল আসতে বলব?
ঘাটোয়ারিবাবু চাদর ঠেলে উঠে বসলে ফের দুঃখবাবু প্রশ্ন করলেন, শরীরটা আজ কেমন আছে আপনার?
ভালো আছি, বেশ আছি, কাল আদার কুঁচি, গরম জল খাওয়ায় বেশ কাজ দিয়েছে। একটু হেসে বললেন, ওদের বলে দিন টাকাটা কালই দেব। আপনি আজ এক ফাঁকে অফিস থেকে টাকাটা নিয়ে আসবেন। আপনার একটু অসুবিধে হবে বুঝতে পারছি।
কী আর অসুবিধে হবে! আসবার সময় বাড়ি হয়ে আসতে পারব। ওদের একটু বাজার করে দিয়ে আসতে পারব। এই বলে দুঃখবাবু ঘরে গিয়ে দেখলেন নেলি তখনও কোনায় চুপচাপ বসে আছে। বাবুকে ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। বলল, কী বুলবি বাবু?
বোস বলছি। দুঃখবাবু বলতে ইতস্তত করছেন। আঁধার রাতের পৃথিবীটা যেন এ পৃথিবী নয়। যেন এটা অন্য পৃথিবী। এই নিদারুণ পৃথিবীতে যেন আবেগধর্মিতার কোনো স্থান নেই। এই নিদারুণ পৃথিবীতে সমাজ আছে, সংসার আছে। বাপ হব বললেই হওয়া যায় না। ভালোবাসব বললেই ভালোবাসা যায় না। বরং তিনি যেন এখন সংসারের চোখে দেখছেন নেলিকে। নেলি হয়তো সকলকে একদিন বলে বেড়াবে এটা দুঃখবাবুর বেটা আছে। অথবা এতদিনে বলে দিয়েছে। তিনি নেলিকে আরও কাছে এসে বসতে বললেন। তারপর নেলির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, লোককে কিছু বলেছিস?