এ সব শুনে গেরস্ত বৌদের দয়া হত যেন। করুণা হত। এমন নাক চোখ মেয়েটার। এমন শরীর মেয়েটার। কেউ বলে নেই ওর! ওরা সেজন্য চাল দিত, ধান দিত বেশি। পয়সা দিত। নেলি সব মাথায় করে চটানে ফিরত, ঝাড়োর সঙ্গে হিসাব করতে বসত। ঝাড়োর পাওনা মিটিয়ে সে ঘরে ফিরত। ঘরে ফিরতে রাত হত কোনোদিন। দূর গাঁয়ে গাওয়াল করতে গেলেই এমন হত। পেটের বাচ্চাটার জন্য নেলি গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে গাওয়াল করতে করতে কতদিন কোথায় চলে গেছে! কতদিন সূর্য মাথার উপরে উঠে কখন হেলতে আরম্ভ করেছে, কখন বিকেল হয়েছে খেয়াল থাকত না নেলির, সে হাঁটত। হাঁটত। সে ঘরে ঘরে গাওয়াল করত ফলন্ত শরীরের জন্য মায়া হত। বাচ্চাটার জন্য মায়া হত। গঙ্গা—যমুনা পাশে পাশে থাকত। পাশে পাশে হাঁটত। চাল, ধান, পয়সা কত হল, দু—চার বাড়ি গাওয়াল করে নিতে পারলে, দু—চারটা গ্রাম ঘুরতে পারলে আর কত হতে পারে—সেই হিসাব শুধু মনে। বাপ ফের ওর ঘরে ফিরে আসছে, বাপ আবার ওকে শাসন করতে আসছে—এই ভাবনায় সে শুধু পথ চলত। মাঝে মাঝে গঙ্গা—যমুনাকে বলত, তুগো একটা ভাই হবে। হামার মতোই কিন্তুক ওয়াকে ভালোবেসে লিবি, হামি তো একা একা তুদের জন্য কুথা চলে যাব, তখন তুরা উয়াকে পাহারা দিবি।
প্রতিদিনের মতো আজও চটানে সূর্য উঠছে। প্রতিদিনের মতো আজও চটান থেকে নামছে নেলি। সঙ্গে গঙ্গা—যমুনা। নেলির মাথায় ডালা, কুলো, ঝুড়ি। দিন রাত বসে ঝাড়ো আর ওর বৌ—ছেলেরা এসব তৈরি করেছে। নেলি ওদের থেকে কিনে নিচ্ছে। দূর গাঁয়ে ডালা—কুলো সব বিক্রি করছে। সে এখন নদী পার হবে। গ্রীষ্মের নদী শুকনো। মরা নদী। কোথাও কোথাও জল জমে আছে। কোথাও কোথাও বালি চিকচিক করছে। জল আয়নার মতো। নেলি নদীর জল ভেঙে পার হওয়ার আগে দু—আঁজলা জল খেল। বলল, মায়ী গঙ্গা তুর দুধ খেয়ে লিলাম।
নেলি নদী পার হয়ে তিলতলা, গোয়ালজান, রসরাজপুর, হলদিচক, পদ্মনাভপুর হয়ে কান্দি, বাসন্তী বলরামপুরে ঘুরে যখন কোনো বাড়ির ভিতর ঢুকে দুটো কথা বলে বিশ্রাম করত, তখন কেউ প্রশ্ন করত—মুখটা ত শুকিয়ে গেছে রে। কিছু খেয়ে বুঝি বের হসনি।
কি যে বুলেন মা! না খেয়ে ফলন্ত শরীর নিয়ে বের হতে আছে। মায়ীর দুধ খেয়ে লিছি, সারা দিনমানে ভুখ আর না লাগবে মা মাসি। তবু যদি ওরা পীড়াপীড়ি করত নেলি তখন দুটো খেয়ে বলত মা ঠাকরুণ, বড় দয়া আপনাগ। হামার গঙ্গা—যমুনাকে দুটো দিলাম—কিছু মনে করে লিবেন না।
সকলে কুকুর দুটোকে তখন দেখত। কুকুর দুটোকে দেখে ওরা ভয় পেত। কুকুর দুটোর দিকে চেয়ে ওরা বলত, এ দুটোকে সামলে চলিস বাপু। কুকুর পুষিসনি তো যম পুষেছিস। কখন কার সর্বনাশ করবে—তখন বুঝবি ঠেলা।
মা—মাসিরা অমন কথা বুলবেন না। ওরা হামার বেটা আছে। ওরা হামার সাত জনমের মেহমান। নেলি কুকুর দুটোকে ধরে চুকচুক করত। ওর আদর করার ঢং দেখে গেরস্ত বৌরা হাসত।
সেদিনও নদী পার হয়ে চটানে ফিরতে রাত হয়ে গেল। অন্ধকার পথ—কিছু দেখা যায় না। কুকুর দুটো ওকে পথ দেখিয়ে চলেছে। নেলি হাঁটছে পা চালিয়ে। মাথায় চালধানের বোঝা। শরীর ভারী বলে পা চালাতে পারছে না। বালিয়াড়ি অতিক্রম করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নদীর পারে ওঠার সময় সে খুব হাঁপিয়ে পড়ল। এখানে একটু বসল নেলি। সারাটা দিন স্যাঁকা রুটির মতো গরমে সে পুড়েছে। নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় বসে থাকতে ওর খুব ভালো লাগল। এখানে বসে চটানের আলো দেখতে পেল সে। দুঃখবাবু হয়তো এতক্ষণে ঘরে ফিরে গেছেন। শনিয়া, গেরু হয়তো মাচানে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্মশানে আগুন জ্বলছে না। এখানে বসে বাবলার ঘন বনে কুকুর দুটোর আওয়াজ পেল। ওরা বুঝি শেয়াল তাড়াচ্ছে ভেতরে। নেলি কী ভেবে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। যেন শরীরটাকে ঘাসের ওপর বিছিয়ে দিয়ে একটু ঠান্ডা হতে দিল। শুয়ে শুয়ে নেলি এক, দুই করে তারা গুণল। এক, দুই করে ঘণ্টা পেটার আওয়াজ শুনল। এক, দুই করে এতদিনের সঞ্চয়ের কড়ি হিসাব করল।—বাপ, বাপরে। পেটের নিচে হাত বুলিয়ে যেন বলতে চাইল, তু আচ্ছা আছে ত বাপ! নেলি আরও নিচে হাত নামিয়ে বাচ্চাটাকে আদর করবার সময় লক্ষ্য করল, কে যেন সন্তর্পণে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
নেলি ভয় পাওয়ার মতন করে বলল, কৌন? কৌন ওখানটায়? সে ডেকে উঠল, গঙ্গা! যমুনা!
দুঃখবাবু বললেন, আমি নেলি, তোর দুঃখবাবু!
বাবু! হামার খুব ভয়ে ধরেছিল বাবু।
খুব গরম পড়েছে। শরীরে ঠান্ডা হাওয়া লাগাচ্ছিস।
আজ রাতে তু বাবু ঘাটে থাকবি বুঝি?
ঘাটোয়ারিবাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলে আজ রাতে থেকে গেলাম।
তবে বস না এখানে। বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তবুও শরীরটা ঠান্ডা হবে। হামার ভি শরীর ঠান্ডা হবে।
আকাশে তেমনি নক্ষত্র জ্বলছে। দুটো পাশাপাশি নক্ষত্রের মতো ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে থাকল। দুঃখবাবু বললেন, তোর শরীর ভালো যাচ্ছে ত?
নেলি ভাবল, এতদিনে বাবু সময় পেল জানার শরীর ভালো যাচ্ছে কী মন্দ যাচ্ছে। নেলি হাসল। সে এতদিন দেখে এসেছে—বাবু রোজ ঘাটে এসেছেন, রোজ ঘাটোয়ারিবাবুর সাথে বসে গল্প করছেন। অথচ চটানে নেমে একবারও বলেননি নেলি ঘরে আছিস নাকি? তোর শরীর শুনছি ভালো যাচ্ছে না। বাবু রোজ আসতেন ভয়ে ভয়ে, রোজ বের হয়ে যেতেন ভয়ে ভয়ে, অথচ একদিনও ডেকে বললেন না, আমি এসেছি। অথবা বললেন না, সব জানি। এই সব দেখে অনেকদিন নেলির বলতে ইচ্ছে হয়েছে, বাবু হামি কাউকে বুলবে না তু হামার বাচ্চার বাপ আচ্ছিস। বুলবে না তু একরাতের মরদ হয়েছিলি হামার।