শালে তু। গেরু লাফ দিয়ে কোণ থেকে সড়কিটা টেনে নিতেই কুকুটা ভয়ে ছুটে পালাল। গেরু কুকুরটাকে তাড়াবার জন্য উঠোন পর্যন্ত নামল এবং বারান্দায় বাপকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল বাপের শরীরটা শক্ত হয়ে আছে।
কৈলাস ডোম মারা গেছে।
একদিন গেল, দুদিন গেল। একমাস, দু—মাস গেল। চটানে গোমানি নেই, কৈলাস নেই। তেমন নাচন—কোঁদন নেই, হৈ—হল্লা নেই। শীত কমে গেছে। শিমুল গাছে ফুল থেকে ফল ধরেছে। ফল কেটে এখন তুলা উড়ছে শ্মশানে, চটানে। হাওয়া উঠছে দুপুরের দিকে। ঝাড়ো ডোম ওর ঘরটার ওপর বেশি কাঁথা—কাপড় চাপাচ্ছে। দুখিয়া একটা মাটির ঘর তুলছে।
গেরু এখন ফরাসডাঙায় মাঝে মাঝে যায়। শনিয়া সেজেগুজে রাতে শুয়ে থাকে। সে—দিন ওরা সিনেমায় গিয়েছিল, শনিয়া প্রায়ই গুনগুন করে হিন্দি গান গায়। শনিয়া নেলিকে গানটা একদিন শুনিয়েছে। এতদিন শনিয়ার ওপর যে রাগ ছিল গান শোনানোর পর থেকে সে রাগ আর থাকল না। রাগটা কেমন করে যেন জল হয়ে গেল। এবং সেদিন থেকেই শনিয়ার সঙ্গে দু—চারটা সুখ—দুঃখের কথা বলে নেলি সুখ পাচ্ছে।
আর সেইদিনই নেলির একবার বমি করার প্রবৃত্তি হল। সেদিনই শরীরটা ভারী মনে হল। মনে হল মা—বসুন্ধরা কেমন মাতাল হয়েছেন। মনে হল রাতে কিছু খেলে আবার বমি হবে। কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। সমস্ত মুখে কেমন বিশ্রী থুতু উঠছে কেবল। সে একবার উঠে থুতু ফেলল, দু—বার ফেলল, তিনবার ফেলল—শেষে পারল না। মাচানে শুয়ে শুয়েই থুতু ছিটাতে থাকল। ঘরে আলো জ্বালল না নেলি। আঁধারের ভিতর চুপচাপ শুয়ে রইল। এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার সময় যে চোখে—মুখে অন্ধকার দেখল। মনে হল পিসির কথা। ঝাড়োর বৌর কথা মনে হল। ওরা চটানে বাচ্চা দেবার আগে যে সব উপসর্গে কাতর হত নেলিও সেই রকম উপসর্গে কাতর হয়ে পড়ছে। নেলি তাড়াতাড়ি মাচানে শুয়ে পড়ল। মনে হল তেষ্টা পেয়েছে খুব। সে ডাকল—শনিয়া শনিয়ারে থোড়া পানি দে। থোড়া পানি দে শনিয়া।
তখন দুঃখবাবু উঠে গেল অফিসারের বারান্দায়। নেলি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুঃখবাবুকে দেখল। সে হাসল। দুঃখবাবুর চোখে—মুখে এখনও লজ্জা। এখনও সংশয়, সংকোচ। দুঃখবাবুর চোখেমুখে সংশয় দেখলে নেলির খুব ভালো লাগে। ওর ইচ্ছা হল ফের সে দুঃখবাবুর পায়ের কাছে গিয়ে বসে। দুঃখবাবুকে ভালোবাসে। বাবুর সব কাজগুলো করে দেয়। দুঃখবাবুর শরীরটা ওর নিজের শরীরে এসে বাসা বেঁধেছে। এই সুখানুভূতিতে নেলি লজ্জায় এবং আনন্দে মুখ গুঁজে দিল। বাপ আবার ফিরে আসছে চটানে, বাপ আবার ওকে আশ্রয় দেবে। বাপ নাচবে—কুঁদবে। নেলি এই সব ভেবে ফের ডাকল, শনিয়া, শনিয়ারে থোড়া পানি দে। থোড়া পানি দে শনিয়া।
শনিয়া ঘরে এসে জল দিল নেলিকে। বলল, আভি তক শুয়ে থাকলি মাচানে। উঠবিনে? তবিয়ত বুঝি আচ্ছা না আছে?
নেলি শুয়ে থেকেই জবাব দিল, আচ্ছা না আছে।
কিছু খাবি—দাবি? রুটি করে লিচ্ছি।
নেলি বলল, দুটো আম দিয়ে অম্বল করে লিবি?
লিব। লেকিন তুর তবিয়ত আচ্ছা না আছে। খাটা খানেসে ভোগান্তি হোবে।
কিছু হোবে না। তু দে লিবি, হামি খেয়ে লিব। হামার কিচ্ছু হোবে না।
শনিয়া চলে যেতে চাইলে নেলির বলতে ইচ্ছা হল, তুকে একটা বাত বুলবে, লেকিন কাউকে বুলবি না। শনিয়া ততক্ষণে চলে গেছে। সুতরাং নেলির বলা হল না। নেলি পাশ ফিরে শুল।
নেলির সুঠাম শক্ত শরীরটা দু—একদিনের মধ্যেই কেমন ভেঙে যেতে লাগল। চটানে সকলেই ধরে ফেলেছে। শনিয়া চুপি চুপি বলেছে গেরুকে। হরীতকী এসে নেলির ঘরে বসে বলেছে—এ আচ্ছা কাজ হল না নেলি। তু ভি হামার মতো হলি। জ্বলে পুড়ে থাক হবি। যেন বলতে চাইল হরীতকী, তুকে নতুন বাবু থোড়াই কেয়ার করবে।
নেলি কোনো কথারই জবাব দিচ্ছিল না। সে চুপচাপ মাচানে পড়ে পাশের একটা মালসাতে থুতু ফেলছে। চোখ দুটো জ্বলছে। যেন বলতে চায়, ডাইনি মাগির আবার ভালো মন্দ। একটা বাচ্চা হবে তার আবার নতুন বাবু, পুরানা বাবু! তার আবার গেরু, টুনুয়া। গেরুর বিবি শনিয়া না হয়ে নেলি হতে পারত, চটানের যে—কোনো মেয়ে হতে পারত। এসব ভেবেও নেলি জবাব দিল না। এইসব ভেবে ভেবেই যেন চোখ দুটো ওর নিচে বসে যাচ্ছে। কেমন করুণ দেখাচ্ছে। গিরিশ কিছু বলছে না গেরু বলছে না কিছু। মংলি ঘরে ঘরে ঢিঢি দিয়ে বেড়াচ্ছে। গোমানি মরল—তার মেয়েটাও মরদ ধরল। এমন সব কথা বলে মংলি সুখ বাড়াচ্ছে, মনের ঝাল ঝাড়ছে নেলি মাচানে শুয়ে সব শুনেও কোনো জবাব দিত না। অথবা জবাব দেওয়ার ইচ্ছা থাকত না।
নেলির এ বমি—বমি ভাবটা কিন্তু বেশিদিন থাকল না। থুতু ফেলাটাও কখন কমে গেল। তখন বৈশাখ—জ্যৈষ্ঠ মাস। গরমে ঘর—বার হওয়া দায়। নেলি এমন দিনেই আবার ঘর—বার হতে থাকল। ফলন্ত শরীর নিয়ে নেলি ঝাড়ো ডোমের সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করল। ঝাড়োর কাছ থেকে ডালাকুলো নিয়ে সে চটান থেকে বের হয়ে যেত। দুপুর রোদে গাওয়াল করে বেড়াত। গেরস্ত বাড়ি ঢুকে বলত, মা মাসিরা আছেন লাকি! ডালাকুলো লেন।
গেরস্ত বৌরা বলত, তোর ডালা—কুলোর দাম বড় বেশি নেলি।
তা যে হবেই মা মাসি। হামার যে আর কেউ লেইগ মা মাসি। থাকলে কমে দিতে পারতাম। এ পয়সায় হামি খাব, কিছু সঞ্চয় করে লিব। হামার ফলন্ত শরীরটা আর কদিন একা থাকবে মা মাসি।