কিছুদূর এসে কৈলাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পিছনে ঢিবি, নিচে জ্বলো, ঘাস ওবোৎল্যাংড়ায় জঙ্গল ধারে ধারে। ঘন জঙ্গল দুপাশে। জঙ্গলের ভিতর কৈলাসের শরীরটা পড়ে রয়েছে। পড়ে থেকে বিলাপ করছে—হামি গেলামরে, হামারে খেয়ে লিলরে।
গেরু আলো উপরে তুলেও বাপকে দেখতে পাচ্ছে না। দূরে শুধু চিৎকার শুনছে—গিলামরে, খেয়ে লিলরে। আলোতে ওর নিজের ছায়াটা নড়ছে। পোড়ো বাড়িটাতে কারা যেন কথা বলতে শুরু করেছে, কারা যেন সব দরজা জানালাগুলো খুলছে, বন্ধ করছে। ঘাসের ভিতর থেকে গন্ধ উঠছে। গেরু আলোটা নিয়ে আশেপাশের জঙ্গলে খুঁজতে থাকল বাপকে। ঢিবির নিচে নামল গেরু। বাপকে দেখতে পেয়ে বলল, উবুড় হয়ে পড়ে আছিস ক্যানে। কী হয়েছে তুর।
গেরুর উপস্থিতিটা কৈলাসের এ—সময় ভালো লাগল না। মনে হল বেইমানটা সব গোলমাল করে দেবে! এতদিনের গড়ে তোলা সমস্ত বিশ্বাসকে এক মুহূর্তে ভেঙে দেবে। সেজন্য কৈলাস উঠে দাঁড়াল। জামা—কাপড় ঝাড়ল এবং নিজেকে সামলে পায়ের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করতে চাইল। গেরুর হাত ধরে বললে, জলদি চটানে নিয়ে চল। হামি হাঁটতে লারছি। বুক হামার শুকিয়ে উঠছে!
বাপকে ধরে তোলার সময় গেরু দেখল, বাপের পা থেকে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঝোপের ভিতর থেকে কিসে যেন বাপকে কামড়েছে।
সে চিৎকার করে উঠল—বাপ।
তু জলদি চল! বাপ বাপ বলে চিৎকার হাকরালস না।
তুকে বাপ মা মনসার বাহন ছোবল দিছে। তু বস পাটা জলদি বেঁইধে দি।
কৈলাস খেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর তু শালা শুয়োরের ছা, লটকনের বাচ্চা। মা মনসার বাহন কামড় দিছে! বুললি আর অমনি হয়ে গেল! সাহস কিরে লটকনের ছা, কাণি হামারে ছোবল মারবে! হাতে লাগেশ্বর কবচ তুর মুখ দেখার লাগি। শেষে কৈলাস পাগলের মতো হাসল। এবং এ—সময় ওর মুখ দেখলে দুনিয়ার সব মানুষের দয়া হত। নসিবের ঘরে বদলা নেই, বদলা নেই—এ—ভাবটুকু শুধু মুখে। সে চলতে চলতে বলল, ও কিছু লয় ও কিছু লয়। হুঁ চট খেয়ে পাটা ছিঁড়ে গেল। তু আর বাপ, হামারে একটু ধরে চল।
চাটনে ফিরে কোনোরকমে দুটো চোখ টেনে বলল কৈলাস, বারান্দায় শুইয়ে দে বাপ! দোহাই তুর ওস্তাদের কাউকে ডেকে লিস না। বেশ আছি। আচ্ছাই তবিয়ত আছে। তু থোড়া পানি হামার শিয়রে রেখে যা বাপ। দোহাই তোর ওস্তাদের কাউকে ডেকে লিস না।
চালাঘরের বারান্দায় বাপকে শুইয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকল গেরু। ঘরটা অন্ধকার। সে পকেট থেকে দেশলাই তুলে লম্ফ জ্বালল। হাতের পুঁটলিটা নিচে ঠেলে দিল। মাচানের ওপর শনিয়া শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু এ—শরীর নিয়ে বৌর কাছে যেতে সংকোচ হল। অথবা মনে সংশয়ের জন্ম হচ্ছে। সে বাইরে বের হয়ে হাত—পা ধুলো ভালো করে। চারপাশে আঁধার। অফিসঘরের বারান্দায় ও—পাশে কারা যেন নেমে যাচ্ছে। শুধু দুখিয়ার ঘরে লম্ফ জ্বলছে। অন্য চালাঘরগুলোতে কোনো লম্ফ জ্বলছে না। নেলির ঘর থেকে গঙ্গা—যমুনা চটানে বের হয়ে এল। ওরা শুয়োরের খাটাল পার হয়ে আঁধারে নেমে গেল।
ঘাটে দুটো চিতা জ্বলছে। কিছু মানুষ দুটো মানুষকে পোড়াচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে পোড়া গন্ধ উঠে আসছে। বুক ভরে গন্ধটা নিতে খুব ভালো লাগল। কঙ্কালের গন্ধের চেয়ে ওর এ গন্ধটা ভালো লাগছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাবল গেরু, দুখিয়াকে ডেকে বাপের কালো রক্তের কথা বললে হয়। সে দু—কদম দুখিয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল। ডানদিকের বেড়াটা ঘেঁষে সে দুখিয়ার ঘরে ঢুকল। মদ খেয়ে ওরা দুজনে সন্ধ্যায় উন্মত্ত হয়েছিল, রাতে ঘরে আলো জ্বেলে সুখ সুখ খেলা খেলেছিল। তারপর কখন আলো না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ঘরে ঢুকে দেখল ওরা উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। খাটের কাঁথাকাপড়ের ওপর ওরা দুজন মা—বসুন্ধরার মতোই শান্ত। হাঁড়ির মতো দুটো পেট মদে ঢাক। এইসব দেখে গেরুর যন্ত্রণা বাড়ছে। সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। সে মুখ বাড়াল। সে উঁকি দিল। মংলির শরীরে মা—বসুন্ধরাকে দেখতে পাচ্ছে। সে যেন চিনতে পারছে এরা ভূমি। বীজ দুখিয়া। ভূমি মংলি। মংলির আবাদের ক্ষেত্রটি দুখিয়ার বীজে ভেসে আছে।
দুখিয়াকে ডাকতে পারল না গেরু। শরীরে ওর ভয়ানক উত্তেজনা। চোখ দুটোতে ভয়ানক জ্বালা। শরীরের যন্ত্রণা কমছে না। উঠোনের ওপর নেমে এসেও ওর শরীর ঠান্ডা হচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তাড়াতাড়ি মাচানে শুয়ে শনিয়াকে জাগাল।
তারপর আবার রাত কাটানোর পালা। চটানে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। চিতার আগুনে আকাশ আর লাল হচ্ছে না। বোধ হয় এতক্ষণে মানুষ দুটোর পোড়া শেষ হয়ে গেছে। শনিয়া, গেরু অনেকক্ষণ ধরে ফিসফিস করে কথা বলল। এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ ঘুম ভাঙতে দেরি হল না। মাচানের নিচে কীসের যেন শব্দ। কারা যেন মাচানের নিচে নাচছে। অথবা গোটা কঙ্কালটা প্রাণ পেয়েছে যেন। মাচানের নিচে কঙ্কালটা নাচছে। অথবা কঙ্কালটা হেঁটে বেড়াচ্ছে মাচানের নিচে। সে মাথা তুলে সব শুনল। সে ডাকল—বাপ! বাপ! কিন্তু বারান্দা থেকে কোনো জবাব এল না। সে ভয়ে ভয়ে ফের ডাকল বাপ! বাপ দ্যাখ কঙ্কালটা মাচানের নিচে নেচেকুঁদে লিচ্ছে। তবু বারান্দায় কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাপের কথা মনে হল। তাবিজের কথা মনে হল সঙ্গে সঙ্গে ভয়টা কেটে গেল। তখন লম্ফটা জ্বালল এবং সে আলোতে দেখতে পেল ঘাটের একটি অভুক্ত কুকুর কঙ্কালের রস চুষে খাচ্ছে।