তারপর যখন সে মড়াটাকে বাবলার ঘন জঙ্গলে কাদার ভিতর পুঁতে দিচ্ছিল তখন ভাবল, নসিবের ঘরে বদলা নেই। ওকে ফের বাপ—পিতামহের ব্যবসাতেই নেমে যেতে হল।
সে প্রায় দেড় যুগ। হিসাব করলে যেন আরও বেশি হবে। সেই গেরু এখন সময়ের পথ হেঁটে এসে জোয়ান হয়েছে। সেই গেরু এখন ইংরেজ কুঠির পথ ধরেছে। হাতে লণ্ঠন। কাঁধে বল্লম। জোয়ান গেরু ছুটে ছুটে চলেছে। কৈলাস গেরুর নাগাল পাচ্ছে না। পথ থেকে নিচে নেমে ডহর পার হবার সময় কৈলাস ডাকল, গেরু হামার বাপরে পথ দেখে হাঁট। হারিকেনের আলো ঠিকসে পথে ফ্যাল।
গেরু থামল। হাতে হ্যারিকেন এবং মদের ভাঁড় নিয়ে সে বাপের জন্য অপেক্ষা করল।
শীতের ভিতরও কৈলাসের শরীরটা ভিজে উঠেছে যেন। সে থেমে গেছে যেন। গেরু কাছে এসে একটু দম নিয়ে দাঁড়াল।
গেরু বলল, তু আজ না এলে পারতি বাপ। তু চলতে লারছিস।
চলতে লারছি! কৈলাস ধমকে উঠল—কোন বলিছে চলতে লারছি!
হামি গেরু এ—কথা বলিছে বাপ। তু চলতে লারছিস। ফরাসডাঙায় পথে আসতে তু তিন দফে হাঁফ ছাড়লি।
তিন দফে হাঁফ ছেড়েছি ত বেশ করেছি। বলে, গেরুর হাতের হারিকেনটা জোর করেই টেনে নিল। তারপর এক ধমক, দ্রুত হেঁটে গেরুর মুখে হারিকেন উঁচিয়ে বলল, কোন বলিছে হাম হাঁটতে লারছি? তু দেখেলে! তু নিজের আঁখোসে দেখে লিলি ত! গেরু হামার বাপরে, শালা হামার পুতরে, হামি সব পারি। হামি লড়তে পারি, হামি বসতে পারি। হামি সব পারি।
ওরা পোড়ো বাড়িটা পার হয়ে কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। রাতের আঁধারে ঝিঁঝিরা তেমনি ডাকছে। তেমনি জোনাকি উড়ছে। জোনাকি জ্বলছে। রাতের আঁধারে তেমনি চাপা কান্নার আওয়াজ। ঘাসের ভিতর ছোট ছোট পোকা—মাকড়েরা তেমনি হামাগুড়ি খাচ্ছে।
মদের হাঁড়িটা কবরের পাশে রাখল গেরু। আজ সে ঝোপ—জঙ্গলের বীভৎসতাকে দেখল না, অথবা লক্ষ্য করল না। প্রতিদিনের মতো ওরা মদ খেল। এবং উঠে দাঁড়াল। কোদাল মেরে চাপ চাপ মাটি সরাচ্ছে গেরু। দু—হাতে কৈলাস মাটি সাফ করছে।
অনেকক্ষণ কোদাল মেরে যখন গেরু ক্লান্ত, যখন কপালের ঘাম মুছে বলল, তু দু—চারঠো কোপ দে ত বাপ, তখন কৈলাস কোদাল টেনে বলল, হয়রান হয়ে পড়লি জোয়ান! তু মরদ হামারে বলিছে হাম হাঁটতে লারি!
বাপ বেশ কায়দার সঙ্গে ছোট ছোট কোপ মারছে কবরে। অবসর বুঝে গেরু সরে গেছে কাঁঠাল গাছটার নিচে। অবসর বুঝে কিছুটা মদ টেনে নিল। সে ঝিমোচ্ছে। সে দেখছে—বাপ বেশ কায়দার সঙ্গে মাটি সরাচ্ছে। ওর নেশা পাচ্ছে দেখে সে যেন না বলে পারল না তুর ভালোর জন্যই হামি এ কথা বলিছে। বুড়া হলি। চটানে থাকলে তুর দেহের ভি ভালো, মনের ভি ভালো। হামার ত আঁধার রাতে ভর থাকার কথা লয়! তু তিন তিনটে কবচ পড়ে দেহে হামার বেঁধে দিলি—ভূত পেত, পির, পরি সাপখোপ, বাদী দুশমন কেউ হামার অনিষ্ট করতে লারছে। আঁধার রেতে হামার ডর থাকার কথা লয়। ভূত বলিছে হামি রাজারে!
কৈলাসের মনে তখন ভীষণ দ্বন্দ্ব চলছে। কবরের নিচে থেকে কঙ্কাল টেনে তোলার সময় সে যেন বুঝতে পারছে তিনটি কবচই বেইমান, ইবলিশ। তবু সে সব ভুলে গিয়ে বলল, হে তু রাজার বেটা রাজা। একহাতে হারিকেন লিয়ে গর্তের নিচে বসল গেরু। মাটির ভিতর থেকে খুঁজে খুঁজে হাতের হাড় আঙুলের হাড়—হিসাব করে গোটা কঙ্কালটাই তুলল। তারপর সে উপরে উঠে ফের বসে গেল। গামছাটা সে বিছিয়ে দিল। হাড়গুলো বিছিয়ে দিল। ওস্তাদ কৈলাস এখন হাড়গুলো গামছার ওপর একটা গোটা মানুষের মতো করে সাজাচ্ছে। দুহাতের পাঁচটা পাঁচটা দশটা আঙুল সাজাল। গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত সাজিয়ে দেখল ঠিক আছে। গুণে গুণে সব হাড় গেরু তুলতে পেরেছে।
কৈলাস বলল, দাঁতগুলো কাঁহারে?
হামার হাতে আছে বাপ।
দে—ত, গুণে দেখি ঠিক আছে কিনা।
কৈলাস দাঁতগুলো গুণল। এক দুই করে বত্রিশটা দাঁত। দুর্গন্ধে কৈলাসের মুখটা কুঁচকে উঠেছে। মাঝে মাঝে থুথু ছিটাল। পোড়ো বাড়িটাকে ব্যঙ্গ করল। এবং গোটা কঙ্কালটা মাটির ওপর বিছিয়ে দিয়ে যখন দেখল কবরের নিচে কিছু পড়ে নেই, তখন কৈলাস ব্যস্ত হয়ে খুলিটাকে পরখ করল। চোয়ালের হাড়টা দেখল এবং আলগা দাঁতগুলো গুণে হিসাব করে বুঝল—সাবাস বেটা গেরু, খুঁজে খুঁজে মেয়েমানুষটার সব কটি দাঁত সংগ্রহ করেছে।
সামনে দুটো দাঁত কষ্টিপাথরের মতো কালো। পান—দোক্তার জন্য দাঁতগুলোতে কালো রঙ ধরেছে। গেরুর মা—র কথা মনে আসছে। পান—দোক্তা খেত বৌটা। মুকের একটা দিক সব সময়ের জন্য ফুলে থাকত। ঘাসের নিচে থেকে কিছু বালি নিয়ে কৈলাস সামনের একটা দাঁত ঘষল। বালিতে ঘষে পরিষ্কার করল। পান—দোক্তার পাথর পড়া দাঁতগুলো সাফ হল না, অথচ একটি দাঁত বালির ঘষা খেতে খেতে তামার রঙ ধরল। কৈলাস দাঁতটাকে হাতের সমস্ত জোর দিয়ে পরিষ্কার করল। দেখল তামার বাঁধানো একটা দাঁত। দাঁতটা দেখে ওর শরীর হাত পা সব কাঁপছে। খুঁজলে যেন সে আরও একটা তামার বাঁধানো দাঁত পাবে। সে ভয়ে দাঁতটা খুঁজল না। শুধু গেরুর মার বাঁধানো দাঁত দুটোর কথা ভাবতে গিয়ে কঙ্কালটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হল। কঙ্কালটার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হল। সহসা সে প্রায় ডুকরে উঠেছিল—গেরুর মা তু ভাগ গিলিরে!
কৈলাস তবু গোপনে কাঁদছে। পাশের গেরু পর্যন্ত টের পায়নি—কৈলাস কাঁদছে। কৈলাস হাড়গুলোকে খুব ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করল। খুব ধীরে ধীরে বুকের পাঁজরগুলো চোখের সামনে এনে দেখল। তারপর কোনোরকমে কঙ্কালটা গামছায় বেঁধে পথ চলতে থাকল। গেরু খুব অবাক হয়ে বাপকে অনুসরণ করছে। বাপ যেন ঝোপ—জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অন্ধের মতো ছুটে চলছে। বাপের সঙ্গে সে ছুটে নিজেকে সামলাতে পারছে না।