যখন কৈলাস গেরুর মায়ের মুখ গেরুর মুখে দেখতে পেত, তখন কষ্টটা আরও বাড়ত। সারাদিন—সারা মাস চেষ্টা করে বেঁচে থাকার কোনো এলাদ ঠিক করতে পারছে না কৈলাস। সে ভেঙে পড়েছে। একবার ইচ্ছা হয়েছিল ফের এখান থেকে বের হয়ে পড়ে। কোনো দরগায় অথবা কোনো আখড়ায় হেকিমি দানরির বিদ্যা আরম্ভ করে, অথবা পকেটমারের বিদ্যা। ইচ্ছা হয়েছিল চটানে অনেক ডোমের মতো চুরি, ডাকাতি রাহাজানি করে বাঁচতে। ইচ্ছা হয়েছিল একদিন গেরুর গলা টিপে সব চুকিয়ে দিতে। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। সে তখন সারাদিন সারা মাস নদীর পাড় ধরে হাঁটত এবং কোন আকাশে শকুন উড়ল দেখত। হাতে কৈলাসের লাঠি থাকত, কোমরে একটা চাকু। মরা গোরু—পাঁঠার ছাল তুলে ঘরে ফিরে গেরুর মুখে দুটো দানা দেবার ব্যবস্থা করত।
তখন গেরুটা কত ছোট, কত সরু! সে চুপচাপ বারান্দায় পড়ে থাকত। ঘাটে মরা মানুষ কখন আসবে, কখন বড়মানুষের মড়ার পিছনে খৈ—পয়সা ছিটানো হবে তার অপেক্ষায় সে বারান্দায় পড়ে থাকত। যখন ওরা আসত, গেরু বারান্দা থেকে নেমে শিবমন্দিরের পথে গিয়ে দাঁড়াত। অন্য ডোমের বাচ্চাদের সঙ্গে সে খৈগুলো মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে তুলত। তারপর একটা একটা করে বারান্দায় বসে খেত।
গেরুর একমুঠো ভাত চাই। কৈলাস এবং গেরুর জীবনে একমুঠো ভাতের দাম চড়ে গেছে। সারাদিন—সারামাস ঘুরেও চটানের অভাবকে দূর করতে পারছে না। কৈলাস মাঝে মাঝে ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ হয়ে যেত। সে চটানে ফিরে গেরুকে কাঁদতে দেখলে রাগে দুঃখে ওকে লাথি মারত। যেন লাথি মেরেই খুন করবে এমন একটা ভাব থাকত চোখেমুখে।
সেই সব দিনে এইসব পথ ধরে কৈলাস হাঁটত। এইসব পথে ঝোপে—জঙ্গলে ছাগল, ভেড়া, গোরু, বাছুর খুঁজে বেড়াত। অথবা আকাশ দেখত। আকাশে শকুন উড়ছে, শকুনেরা জটলা করছে—সে ছুটল। শকুনগুলো যতদূর উড়ল সে ততদূর ছুটল। সে ছুটছে আকাশ দেখছে। শকুন উড়ছে। শকুনগুলো কোনো কোনো সময় হাজার হারুন রসিদের মুখ হয়ে আকাশের নিচে ভাসত। ওকে এভাবে ছুটতে দেখে হাসত। যেন বলতে চাইত নসিবের ঘরে কারও রেহাই নেই। যেন বলতে চাইত, নসিব খুনের বদলা নিল। তারপর সে দেখত আকাশ ফুসমন্তরে যেন খালি হয়ে গেল। সেখানে হারুন রসিদের মুখ নেই, শকুন নেই, কিচ্ছু নেই। হারুন রসিদ যেন জাদুমন্তর করে এতদূর কৈলাসকে ছুটিয়ে মেরেছে। তারপর আকাশের সেইসব মুখ একসঙ্গে মেঘ হয়ে আকাশকে ঢেকে দিত। সে তখন চিৎকার করে বলত, শালা রসিদ, তুর সব সহ্য হয়, লেকিন ভণ্ডামি সহ্য হয় না। সে পথের ওপর বসে হাঁপাতে থাকত। ভাবত নসিবের ঘরে বদলা নেই।
সারাদিন ঘুরে একদিন নদীর পার থেকে চটানে ফিরছে কৈলাস। তখন বর্ষাকাল। তখন রাস্তাটা পাকা ছিল না। বাজারের মুখে একহাঁটু কাদা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। গোরুর গাড়িগুলো গাছের নিচে পড়ে আছে। গোরুগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটা গোরুকে ওর বিষ দিতে ইচ্ছা হল। সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করল। গাড়োয়ানরা সব বচসা করছে। সে গাছের নিচে থেকে বিষের পুঁটলিটা কলাপাতায় পেঁচিয়ে বড় গোরুটার সামনে ছুঁড়ে আঁধার থেকে সরে দাঁড়াল।
এমন দিন আরও সব গেছে কৈলাসের। সেদিনও সাঁজ নেমেছিল পারের বাজারে। সেও বর্ষাকাল। রাস্তাটা তখনও পাকা হয়নি। বাজারের মুখে একহাঁটু কাদা। সে মাথায় একটি মোষের চামড়া নিয়ে খেয়াঘাটের পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গোরুর গাড়িগুলো বাড়িমুখো হয়েছে। গাড়ির নিচে লণ্ঠন দুলছে। প্রচণ্ডবেগে গঙ্গার খোলা জল নিচে নামছে। কৈলাস মাথায় ছাল নিয়ে পৃথক হয়ে দাঁড়াল। ছালটার টাকা মিললে তাঁর পাঁচটা ভাগ হবে। বড় সামান্য বড় সামান্য, ওর অংশ। খেয়াতে উঠে খুব আপশোশ হচ্ছে কৈলাসের।
সেদিনই ঘটনাটা ঘটল।
সে রাতেই সে বেঁচে থাকার এলাদ খুঁজে পেল।
খেয়া থেকে নেমে সে হাঁটছিল। নদীর পাড় ধরে, বাবলার ঘন বনের পাশ দিয়ে হাঁটছিল। সে তখন গন্ধ পাচ্ছে, কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছে। দুর্গন্ধ। পচা গন্ধ। সে খুব খুশি হল। সে দেখল বর্ষার নদী ধরে আর একটা ছাগল অথবা গোরু স্রোতের সঙ্গে নিচে নামছে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। সে লোভ সামলাতে পারল না। আকাশের মরা আলো, নদীর ঘোলা জলের উত্তাপ ওকে টেনে নিল। সে জয় ওস্তাদ গুরু বলে লাফ দিয়ে জলে পড়ল। স্রোতের সঙ্গে সেও ভেসে চলেছে। বাবলার ঘন বনের আড়ালে মোষের চামড়াটা রেখে এসেছে কৈলাস। তারপর দুধারে গ্রাম, মাঠ কাশবন। দু—তীরে ঘন সবুজের জঙ্গল, নৌকায় ইতস্তত লণ্ঠন জ্বলছে। কৈলাস সব কাটিয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলল। স্রোতে মরা জন্তুটা ওর সঙ্গে যেন পাল্লা দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত কৈলাস অস্পষ্ট অন্ধকারে ডুব দিয়ে মরা জন্তুটার একটা পা ধরে ফেলল। সে এত ক্লান্ত, এত উন্মত্ত এবং উত্তেজিত যে ধরেই বলে উঠল—শালা কাঁহা যাওগে তুম! লোভ ওকে এমন মাতাল করে তুলেছে যে সে ওটাকে টানতে টানতে পাড়ে এনে তুলল অথচ দেখল না এত মেহনতে ওর হাতে কী ধরা পড়েছে!
জল থেকে টেনে তুলতেই কৈলাসের মাতাল ভাবটুকু থাকল না। সে ভয়ে শিউরে উঠল। ঘৃণায় মুখ কুঁচকে উঠল। ওর ওয়াক উঠতে চাইল। সে দেখল, টেনে তোলা জন্তুটা গোরু ছাগল অথবা ভেড়া নয়। একটা মানুষের শরীর ফুলে ফেঁপে ঢাক হয়েছে। সে আর স্থির থাকতে পারল না, সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, ওস্তাদ গুরুর দোহাই। দোহাই হারুন রসিদের। দোহাই কাছাড় দরগার। সঙ্গে সঙ্গে কৈলাস তাজা হল। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মনে পড়ল ওর বাচ্চা বয়সের কথা। বাপ—পিতামহের কথা। বাপকে দেখেছে, পিতামহকে দেখেছে। এমন কত কঙ্কাল কুড়িয়ে এনেছে মানুষের। চুপি চুপি কলকাতায় যে—সব কঙ্কাল বিক্রি করেছে। বড় হয়ে সে শুনেছিল হিল্টন কোম্পানির কথা। জগুবাজারে সে কোম্পানির অফিস আছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এতদিনে বেঁচে থাকার এলাদ সে পেয়েছে। গেরু আর উপোস করবে না। ওকে আর শকুন দেখে বেড়াতে হবে না। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে। ফের একটা শাদি ধরতে পারবে। ফের চটানে বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে।